সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আত্মনির্ভর ভারত সেকাল একাল

                                                 
সাধনকুমার পাল
 
১৫৯ বছরে এ এক অন্য ২৫শে বৈশাখ,লকডাউনে রবীন্দ্রজয়ন্তী।২৫ বৈশাখ, কবিগুরুর জন্মদিন।তবে ২০২০-তে সেই চেনা ছবি আর ধরা দিল না। দীর্ঘ ১৫৯ বছরে এ এক অন্য সকাল। নেই কোনও আড়ম্বর, নেই শয়ে শয়ে ভক্তের ভিড়। বন্ধ রাস্তা পথঘাট।যে কবি চার দেওয়ালের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার কথা বলে গিয়েছেন, সেই কবিগুরু স্মরণ এবার কোয়ারেন্টাইনে। জানি না কবি কখনো আমাদের মতো এরকম লকডাউনে ছিলেন কিনা।তবে এই চীনা ভাইরাস অতিমারীর আবহে বর্তমান প্রজন্মের মানসিক যন্ত্রনা নিংড়ানো ভাষা হয়তো উপনিষদের ঋষির মতো কবির উপলব্ধিতে ধরা দিয়েছিলো।সেই উপলব্ধি থেকেই হয়তো তিনি লিখে ছিলেন 'সভ্যতার প্রতি' শিরোনামে কয়েকটি পঙ্ তি-

'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব—
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।'

শুধু সভ্যতার প্রতি নয় 'স্বদেশি সমাজ' প্রবন্ধে সে সময় বদলে যাওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গুলির দিকেও আঙুল তুলে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।আধুনিকতার নামে,পরিবর্তনের নামে সে সময় যে দিশায় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে ছিল কবিগুরু তার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।আজ চিনা ভাইরাস অতিমারীর ধাক্কায় সামাজিক, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আবার একবার পরিবর্তনের প্রয়োজনীতা অবশ্যমভাবী বলে মনে হচ্ছে । লকডাউন চলার সময় গত ১২ মে মঙ্গলবার রাত আটটার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষনেও সেই পরিবর্তনের সুরই ধ্বনিত হল।প্রধানমন্ত্রী বললেন বিশ্বগুরু হতে হলে ভারত কে আত্মনির্ভর হতে হবে কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক নয়।এখন সমস্ত বিশ্ব জুরে অর্থকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন বনাম মানব কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের চর্চা হচ্ছে।ভারতই এই মানব কেন্দ্রীক বিশ্বায়ন প্রবক্তা,যার আত্মা বসুধৈব কুটুম্বকম ভাবনার মধ্যে নিহিত।প্রধানমন্ত্রী আরো বললেন, লোকালের জন্য ভোকাল হতে হবে।অর্থাৎ স্থানীয় ভাবে উৎপন্ন উন্নত গুনমান সম্পন্ন দ্রব্য গর্বের সাথে শুধু নিজেরাই নয় অন্যকেও ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

উহান ভাইরাস অতিমারী দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বায়নের নামে বিকাশ নয় বিনাশই হচ্ছে।বিশ্বায়ন হচ্ছে ঔপনিবেশিক শক্তির শোষন শাসনের নতুন হাতিয়ার।এ ছাড়া বিগত বারো বছরে যে হারে বিশ্ব উষ্ণায়ন হয়েছে একই হার যদি বজায় থাকে তাহলে আগামি কুড়ি বছর পর পৃথিবী আরো বড় সংঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে। এছাড়াও নানা কারণে বিশ্বায়ণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল অনেকদিন থেকেই। বেক্সিট অর্থাৎইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেড়িয়ে আসা,ভারতীয়দের জন্যও এইচবি১ ভিসা নিয়ে আমেরিকার কড়াকড়ির মতো ঘটনা চলমান বিশ্বায়ন কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।উহান ভাইরাস অতিমারী চলাকালীন চিন থেকে জাপানি কোম্পানী গুলিকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জাপান সরকার বাজেটে ২২০ বিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দ করেছে এবং যে সমস্ত কোম্পানি চিন থেকে অন্য দেশে যেতে চায় তাদের জন্য ২৩ বিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দ করেছে।কোরিয়ান কোম্পানি গুলি চিন থেকে ভারতে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।অতি সম্প্রতি এফডিআইএর ক্ষেত্রে ভারত সরকার কড়াকড়ি শুরু করে দিয়েছে।চন সহ বিভিন্ন প্রতিবেশি দেশের FDI-এর জন্য সরকারের অগ্রিম অনুমোদন প্রয়োজন।এছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চন থেকে তাদের বিনিয়োগ ফিরিয়ে নিয়ে আসার চিন্তা করছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে চলমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যে আত্মনির্ভরতার কথা বলেছেন তা ভারতের ডিএনএতেই বয়েছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে চোখ রাখলে ভারতের নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আত্মনির্ভরতার বিষয়টি স্পষ্ট করে বোঝা যায়।

ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গুলি ভেঙ্গে দিয়ে ব্রিটেনের আদলে রাজনীতি নির্ভর, সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা কায়েম করে ছিলেন। সমস্যার সূত্রপাত তখন থেকেই। স্বাধীনতা লাভের পর এ দেশের নীতি নির্ধারকরা ভারতকে ইংরেজের ছেড়ে যাওয়া জুতোতে পা গলিয়ে রাজনীতি নির্ভর, সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা বহাল রেখে চলতে বাধ্য করল।ভারত স্বাধীন হল ঠিকই কিন্তু স্বতন্ত্র্য লাভ করল না।

স্বাধীনতার সাত দশক ধরে মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ন ভারত উন্নয়নশীল গরিব দেশের তকমা বহন করে চললেও চলমান অতিমারীর জেরে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরাবস্থা আরো একবার ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।মানুষ দেখেছে সামান্য দিনমজুরি কাজের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে পারি দিতে হচ্ছে।বাড়ি ফেরানোর জন্য ট্রেন, ফ্রি রেশন ইত্যদির ব্যবস্থা করে এই মানুষ গুলির কষ্ঠ লাঘব করতে কেন্দ্রীয় সরকার আপ্রাণ প্রয়াস করছে।কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও রাজ্য সরকারের ভুমিকা দেখে মনে হচ্ছে ওরা যেন মানুষের এই দুরাবস্থা কে আরো বাড়িয়ে তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ভাগ্য ফেরানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছে।ডুবন্ত মানুষকে জল থেকে না তুলে,নিরাপদ দূরত্বে দাড়িয়ে তার ভাগ্য বিপর্যয়ের দায় চাপানোর প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে।সরকারি বেসরকারি সমস্ত ব্যবস্থা গুলি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে এগিয়ে এলে এই মানুষ গুলির কষ্ট নিশ্চিত ভাবে অনেটাই লাঘব হতো।

পরিয়ায়ী শ্রমিকের ঢল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে চীনা ভাইরাস বিপর্যয়ের জেরে ভারতে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। সরকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে কখনই এত মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব নয়।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সমস্যা মোকাবিলায় আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের মাধ্যমে যে সমস্ত প্রকল্প ঘোষণা করেছেন তাতে গ্রাম ও শহরে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভবনা রয়েছে।কোন জামিন বা গ্যারান্টি ছাড়াই ক্ষুদ্র,মাঝারি এবং কুটির শিল্পের জন্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ।আর্থিক ভাবে দুর্বল সংস্থাগুলিকে ২০ হাজার কোটি টাকা অনুদান।২০০ কোটি টাকার প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দরপত্র নয়। ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে বিনা মূল্যে খাদ্যশস্য,শহরে শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়া ,গ্রামে ফিরলে ১০০দিনের কাজে নিয়োগ, ৫০ লক্ষ হকারের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ।আদিবাসী ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান,বৃক্ষরোপন,পতিত জমি পুনরুদ্ধার সহ বিভিন্ন প্রকল্পে ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ,২৫ কোটি কৃষককে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড সমসংখ্যক কৃষকের জন্য ২লক্ষ কোটি টাকা ঋণ,প্রান্তিক চাষিদের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ।মৎসচাষ ও পশুপালনে ঋণের মাধ্যমে আমজনতাকে আত্মনির্ভর করে তোলার প্রয়াস হয়েছে।নেতিবাচক রাজনীতি না করে দেশে একটু সাকারাত্মক পরিবেশ তৈরী করলে করোনা মুক্ত বিশ্বে ভারত সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কারণ এই আত্মনির্ভরতা ভারতের ডিএনএতেই রয়েছে। এই ভাবনার মূলসূত্রটি ধরতে আসুন একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখি।

১৮৩০ খৃষ্টাব্দে ভারতের একজন ব্রিটিশ গভর্নর,স্যার চার্লস মেটকাফ , ভারতের গ্রাম্য সমাজকে বর্ণনা করে বলেছেন: “গ্রাম গুলি ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র;এদের যা-কিছু প্রয়োজন প্রায় সমস্তই এদের নিজেদের মধ্যে আছে; বাইরের কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এদের প্রায় প্রয়োজনই হয় না। যেখানে অন্য কিছুই টিকে থাকে না সেখানেও এরা বেশ টিকে রয়েছে।গ্রাম গুলির এই প্রজা সমাজ ,এদের প্রত্যেকেই এক-একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র বিশেষ – প্রজার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রভুত ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এবং এদের কল্যানে প্রজারা প্রচুর পরিমানে স্বাধীনতা ও স্বরাজ ক্ষমতা ভোগ করতে পারছে।” এই বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট যে এদেশের গ্রাম গুলি যেন প্রায় কল্পনার স্বর্গলোকের মতো ছিল।ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্ত বলেছেন, “বয়নশিল্পই তখন আমাদের জাতীয় শিল্প ছিল ,এবং মেয়েরা ঘরে ঘরে চরকায় সুতো কাটতো”।ভারতীয় বস্ত্র ইংলন্ডে নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও যেত।তা ছাড়া ,চিন জাপান বহ্মদেশ আরব পারশ্য এবং আফ্রিকার কোনো কোনো দেশেও যেতো । ভারতের বস্ত্র শিল্প এতই উন্নত ছিল যে ,ইংলন্ডে যন্ত্রে প্রস্তুত বস্ত্র তার সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পেরে উঠতো না ।ইংলন্ডের বয়ন শিল্পকে রক্ষা করা জন্য ভারতীয় বস্ত্র শিল্পের উপর শতকরা আশি টাকা হারে শুল্ক বসানো হয়ে ছিল। বিদেশি বাণিজ্যের আক্রমনে ভারতের বস্ত্র শিল্প বিনাশ প্রাপ্ত হল।ফলে বহু মানুষ কাজ হারালেন।১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষমতাসীন বড়লাট বলেছিলেন, “দেশময় দুর্দশা দেখা দিয়েছে,জগতে ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার তাঁতিদের হাড়গোরে মাঠঘাট ছেয়ে গেছে।”

স্পষ্টতই ইংরেজরা এদেশের মজবুত আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ইংলন্ডের অনুকরণে রাজনীতি সর্বস্ব, সরকারী ব্যবস্থা নির্ভর ব্যবস্থা কয়েম করেছিল।এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলম ধরে ছিলেন কবিগুরু।                                     

স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “সমাজই বিদ্যার ব্যবস্থা করেছে, তৃষিতকে জল দিয়েছে, ক্ষুধিতকে অন্ন, পূজার্থীকে মন্দির, অপরাধীকে দগু, শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা । গ্রামে গ্রামে দেশের চরিত্রকে রক্ষিত এবং তার শেকড় প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশের উপর দিয়ে রাজ্য-সাম্রাজ্যের পরিবর্তন হয়ে গেল, স্বদেশী রাজায় রাজায় নিয়তই রাজত্ব নিয়ে হাত-ফেরাফেরি চলল, বিদেশী রাজার এসে সিংহাসন-কাড়াকড়ি করতে লাগল, লুঠপট অত্যাচারও কম হল না, কিন্তু তবু দেশের আত্মরক্ষা হয়েছে, যেহেতু সে আপন কাজ আপনি করেছে, তার অন্নবস্ত্র ধর্মকর্ম সমস্তই তার আপনারই হাতে। এমনি করে দেশ ছিল দেশের লোকের; রাজা ছিল তার এক অংশে মাত্র, মাথার উপর যেমন মুকুট থাকে তেমনি । রাষ্ট্রপ্রধান দেশে রাষ্ট্রতন্ত্রের মধ্যেই বিশেষভাবে বদ্ধ থাকে দেশের মর্মস্থান; সমাজপ্রধান দেশে দেশের প্রাণ সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রের পতনে দেশের অধঃপতন, তাতেই সে মারা যায়। গ্রীস রোম এমনি করেই মারা গিয়েছে। কিন্তু চীন ও ভারত রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের ভিতর দিয়েই সুদীর্ঘকাল আত্মরক্ষা করেছে, তার কারণ– সর্বব্যাপী সমাজে তার আত্মা প্রসারিত । পাশ্চাত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে। গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল, রাজশাসন তাকে অধিকার করলে। যখন থেকে এই অধিকার পাকা হয়ে উঠল তখন থেকে গ্রামে গ্রামে দিঘিতে গেল জল শুকিয়ে, জীর্ণ মন্দিরে শূন্য অতিথিশালায় উঠল অশথ গাছ, জাল-জালিয়াতি মিথ্যা-মকদ্দমাকে বাধা দেবার কিছু রইল না, রোগে তাপে অজ্ঞানে অধর্মে সমস্ত দেশ রসাতলে তলিয়ে গেল । সকলের চেয়ে বিপদ হল এই যে, দেশ দেশের লোকের কাছে কিছু মর্মকথা চাইলে আর সাড়া পায় না। জলদান অন্নদান বিদ্যাদান সমস্তই সরকারবাহাদুরের মুখ তাকিয়ে। এইখানেই দেশ গভীরভাবে আপনাকে হারিয়েছে।.....সমাজে তাই আমি বলেছিলুম ইংরেজ আমাদের রাজা কিম্বা আর কেউ আমাদের রাজা এই কথাটা নিয়ে বকবকি করে সময় নষ্ট না ক’রে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, নিজের দেশকে নিজে সত্যভাবে অধিকার করবার চেষ্টা সর্বাগ্রে করতে হবে। দেশের সমস্ত বুদ্ধিশক্তি ও কর্মশক্তিকে সংঘবদ্ধ আকারে কেমন করে দেশে বিস্তীর্ণ করা যেতে পারে, স্বদেশী-সমাজে আমি তারই আদর্শ ব্যাখ্যা করেছিলুম।”

আমি এই কথাই বিশেষ করিয়া বুঝাইবার চেষ্ঠা করিয়াছি যে ,বিলাতে যেমনই হোউক , আমাদের দেশে সমাজ একটি ক্ষুদ্র ব্যাপার নহে- যুদ্ধ বিগ্রহ , কিয়ৎ পরিমাণে পাহারার কাজ ও কিঞ্চিৎ পরিমানে বিচারের কাজ ছাড়া দেশের আর সমস্ত মঙ্গল কার্যই আমাদের সমাজ নিজের হাতে রাখিয়া ছিল।ইহাই আমাদের বিশেষত্ব।এই জন্যই এই সমাজব্যবস্থার উপরেই আমাদের মনুষত্ব ,আমাদের সভ্যতা স্থাপিত এবং এইজন্য এই সমাজ ব্যবস্থাকে আমরা চিরদিন সর্বতোভাবে স্বাধীন ও সক্রিয় রাখিতে একান্ত সচেষ্ঠ ছিলাম।”

একটি পরিসংখ্যান বলছে স্বাধীনতার সাতদশক পরেও নাকি ২০ কোটি ভারতবাসী পেটে ক্ষুধা নিয়ে , না খেয়ে ঘুমুতে যায়।কিন্তু লকডাউনের মতো চরম সঙ্কটে সরকারি সাহায্যের লাল ফিতের ফাঁস খোলার অপেক্ষা না করে সমস্ত দেশ জুড়ে সেবা কাজের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যে ভাবে সক্রিয়তা প্রদর্শন করেছে তা এক কথায় অভুতপূর্ব।এতে প্রমাণ হয় 'সরকার নয়', 'সমাজ সর্বোপরি' এই আদর্শ এখনো ভারতের ডিএনএতে সক্রিয়।এই জন্যই বোধ হয় লকডাউনে অনাহারে মৃত্যুর খবর নেই।

গান্ধীজীও ভাবতেন আমাদের দেশ কখনো না কখনো “স্বরাজ” অর্জন করবে। সরকারের উপর নুন্যতম নির্ভরশীলতা গান্ধীজীর স্বরাজের মূল ভাব। দেশপ্রেম ও রাষ্ট্র সর্বোপরি।গ্রাম স্বরাজের এই ধারণা যে আধুনিক সময়েও সম্ভব তার দৃষ্টান্তও ইতিমধ্যে তৈরী হয়েছে।ভারতরত্ন নানাজী দেশমুখের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গ্রাম বিকাশের কাজের ফলে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের পাঁচশোর অধিক গ্রাম এখন স্বনির্ভর।আন্না হাজারে নেতৃত্বে শুরু হওয়া খরা প্রবণ , দুর্ভিক্ষ পিড়িত মহারাষ্ট্রের রালেগাও সিন্ধ্রি এখন সমস্ত বিশ্বের সামনে এক দৃষ্টান্ত তৈরী করেছে। রালেগাও সিন্ধ্রি যেখানে এক সময় ৮০ শতাংশ মানুষ না খেয়ে থাকতেন,গ্রাম থেকে আট দশ কিলোমিটার দুরে গ্রামবাসীরা যেতেন পাথর ভেঙ্গে সামান্য আয় করার জন্য ,এখন ঐ গ্রামে বাইরের মানুষ আসে কাজের সন্ধানে । খরা পীড়িত এই গ্রামে একসময় একবার ফসল ফলানোর মতো জল পাওয়া যেতো না এখন সেখানে চেক ড্যামের মাধ্যমে বৃষ্টির জল ধরে রেখে কম করে বছরে দুবার ফসল ফলানো হয়।দুশো থেকে ২৫০ ট্রাক পেয়াজ এখন ব্যঙ্গালোর চেন্নাইএর মতো বড় বড় শহরে সরবরাহ করা হয়। আগে ঐ গ্রামে ৪০০ লিটার দুধ প্রবেশ করতো না ,এখন ঐ গ্রাম থেকে ৬০০০লিটার দুধ প্রতিদিন বাইরে যায়।ফলে প্রতিদিন সোয়াশো থেকে দেড় লাখ টাকা প্রতিদিন গ্রামে ঢুকছে ।ঐ গ্রামে দুই কক্ষের একটি ঘরে দুজন শিক্ষক দিয়ে চতুর্থ শ্রেনি পর্যন্ত একটি স্কুল চলতো।এখন ঐ গ্রামে ৪০ জন শিক্ষক , বিজ্ঞান বিভাগ সহ দ্বাদস শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা হয় ।বাইরের গ্রাম থেকেও এখন পড়তে আসে। না ,কোন সরকারী সহায়তা নয় ,বহুজাতীক কোম্পানির বিনিয়োগ নয়,বা কোন ধন কুবেরের কৃপাদৃষ্টি নয়,সম্পূর্ন নিজস্ব উদ্যোগে এটা সম্ভব হয়েছে।।রালেগাও সিন্ধ্রির মতো অনুবর্বর জমিযুক্ত খরা পিড়িত গ্রাম যদি লক্ষীর ঝাঁপির স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে তাহলে ভারতের অন্য গ্রামগুলি পারবে না কেন? ভারতরত্ন নানাজি দেশমুখ ও আন্না হাজরের গ্রাম স্বরাজের সফল প্রয়োগ ও 'স্বদেশি সমাজ' প্রবন্ধে কবিগুরুর ভাবনা যে নতুন পরিবর্তনের রোড ম্যাপ হয়ে উঠবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ##


মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো সময়োপযোগী লেখা পড়লাম। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিম্নবিত্ত মানুষেরাও নতুন কিছু চাইছে। কর্মসংস্থান বড় ইস্যু।

    উত্তরমুছুন
  2. সঠিক কথাই বলা হয়েছে। আমি নিশ্চিত আমরা ধীরে হয়তো অতি ধীরে চলেছি, কিন্তু নিশ্চিত সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি। আত্ম নির্ভর ভারত আজ আর আকাশ কুসুম কল্পনা নয়, হয়তো এক দশক বা তার কিছু কম বেশি সময়ের মধ্যেই এর সুফল সমাজ উপভোগ করবে।
    শুভায় ভবতু।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...