![]()  | 
| সাধনকুমার পাল | 
২ অক্টোবর শিক্ষকদের একটি সম্মেলনে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ নিয়ে আলোচনার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর প্রথমেই মনে হল ঐ দিন গান্ধীজয়ন্তী ।২০২০-তে আমরা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ১৫১তম জন্মবার্ষিকী পালন করতে চলেছি।গুজরাতের পোরবন্দরে ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।স্বাভাবিক ভাবেই এই আলোচনার আমন্ত্রণ গান্ধীজীর শিক্ষাচিন্তার আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ এর প্রাসঙ্গিকতা যাচাইয়ের সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল। প্রথমেই গান্ধীজীর শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণা দেখে নেওয়া যেতে পারে।
গান্ধীজী বলেছিলেন,' প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য হবে মানুষের ব্যক্তিত্বের সার্বিক উন্নয়ন তথা ,শারীরিক , মানসিক,নৈতিক সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ।' গান্ধীজী ১৯৩৭ সালে হরিজন পত্রিকায় লিখেছিলেন ,' শিক্ষা বলতে আমি বুঝি শিশুর দেহ ,মন ,আত্মার সর্বাঙ্গীন বিকাশ।স্বাক্ষরতা শিক্ষার প্রারম্ভিক বা অন্তিম কোন বিষয় নয়। এটি শিক্ষার অন্যতম উপায় যার মাধ্যমে নরনারী শিক্ষিত হতে পারে।স্বাক্ষরতা নিজে কোন শিক্ষা নয়।তাই আমি একটি প্রয়োজনীয় উৎপাদনে উপযোগী কোন হস্তশিল্পের মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা করবো।'
গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা দুর করতে ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে ওয়ার্ধায় গান্ধীজী এক নুতন শিক্ষা পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেন।ওয়ার্ধায় নেওয়া শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাবসমূহকে বলা হয় বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা বা ওয়ার্ধা পরিকল্পনা( Wardha scheme of basic Education) ।এই বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য ছিল শিশুকেন্দ্রিক, জীবনকেন্দ্রিক, শিল্পকেন্দ্রিক এবং স্বয়ম্ভর( Child Centred,Life Centred ,Craft Centred and Self-Sufficient). বুনিয়াদি শিক্ষার মূল কথা হল,'কাজের মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরণ।' অর্থাৎ জীবনের মাধ্যমে জীবনের জন্য শিক্ষা। গান্ধীজী চেয়ে ছিলেন নতুন শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে আমাদের লুপ্ত গ্রাম্য গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে হবে।সেজন্য জাকির হোসেন কমিটির রিপোর্টের মুখবন্ধে গান্ধীজী লিখে ছিলেন 'The Scheme is a revolution in the education of village children.'
গান্ধীজীর বুনিয়াদী শিক্ষার প্রস্তাব গুলি খতিয়ে দেখার জন্য ড: জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয় ।কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আচার্য বিনোভা ভাবে,কাকা কালেলকর ,জে সি কুমারাপ্পা, কিশোরীলাল মাস্রুওয়ালা প্রমূখ।১৯৩৭-৩৮ সালে এই কমিটি দুটি রিপোর্ট পেশ করে ।জাকির হোসেন কমিটির রিপোর্টে বলা হয় –
১) সাত থেকে চৌদ্দ বছরের ছেলেমেয়েদের বুনিয়াদি শিক্ষা দিতে হবে।
২)শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতা মূলক।
৩)শিক্ষা দেওয়া হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে।
পাঠক্রমে থাকবে - ক) মৌল শিক্ষা - সুতো কাটা, বয়ন,চামড়ার কাজ ,কাঠের কাজ,কৃষি বা স্থানীয় অবস্থা অনুযায়ী যে কোন একটি শিল্প। খ) মাতৃভাষা গ) গনিত ঘ) সমাজ বিজ্ঞান, ভুগোল ,ইতিহাস,পৌর বিজ্ঞান ,গ্রামীন অর্থনীতি ইত্যাদি।ঙ) সাধারণ বিজ্ঞান- প্রকৃতিপাঠ, জীববিদ্যা, স্বাস্থ্য , শারীরবিদ্যা। চ) সংগীত ছ) চারুশিল্প জ) হিন্দুস্থানী ভাষা।
বুনিয়াদী শিক্ষায় ইংরেজীর পরিবর্তে হিন্দুস্থানী ভাষাকে সর্বভারতীয় জাতীয় ভাষা রুপে গ্রহন করার সুপারিশ করা হয়।কংগ্রেসের হরিপুরা গৃহীত হওয়ার পর ১৯৩৯ সালে সেবাগ্রামে' হিন্দুস্থানী তালীমী সংঘ' নামে নিখিল ভারত জাতীয় শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হয়।
জাকির হোসেন কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর অনেকেই একে অবাস্তব পরিকল্পনা বলে সমালোচনা করেণ।সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করা হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে স্বনির্ভর করার প্রস্তাব কে।স্কুলের ব্যয় ও শিক্ষকের বেতন সংগ্রহ করতে হলে নাকি স্কুল কে কারখানায় পরিণত করতে হবে। কেবল মাত্র একটি হস্ত শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রকল্প পদ্ধতিতে পড়ানো এক অবাস্তব পরিকল্পনা।শিল্পের জন্য দুই ঘন্টা ব্যয় করে বাকি দুই ঘন্টায় অন্যান্য বিষয় গুলি পড়ানোর সম্ভবনা কম।এই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য উপযোগী শিক্ষক পাওয়া কষ্ঠ সাধ্য।
তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আধুনিকতাকে স্বাগত জানাতে ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ ভাবে ত্যাগ করা অপ্রয়োজনীয়। উনি চাইতেন, আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের একটা মিলনক্ষেত্র, যাকে আধুনিক বিশ্লেষকরা বলেছেন traditional modernity। আজকে বিশ্বায়নের যুগে একটা দেশ বা একটা সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য দেশ বা অন্য সংস্কৃতির আদান-প্রদান অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবী একটা ছোট্ট গ্রামে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু ১ জুন ১৯২১-এ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-য় গাঁধীজি সতর্ক করেন, যাতে উন্নত দেশের সঙ্গে আদান-প্রদানের ফলে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পায়ের তলার মাটি সরে না যায়।
গাঁধীজি চাইতেন, শিক্ষার মূল স্রোতের সঙ্গে কারিগরি বা বুনিয়াদি বিদ্যাকে যুক্ত করতে। স্বাধীন ভারতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘জাতীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন গাঁধীজি।মহাত্মা ভেবেছিলেন স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয় শিক্ষাদান প্রথা প্রবর্তনে ব্রতী হবে। বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করা হবে ভারতীয় পদ্ধতিতে, পশ্চিমি পদ্ধতিতে নয়। গাঁধীজির এই ভাবনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
পশ্চিমি সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের বদলে গান্ধীজি গ্রাম নির্ভর অর্থনীতি ও কর্মকেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে ছিলেন।একদল নতুন শিক্ষকের প্রয়োজনীতা আজ সবথেকে বেশি যারা বুনিয়াদি শিক্ষাক্রমকে সঠিক আত্মস্থ করতে পারবে। শিক্ষা তার কাছে একঘেয়ে নয় বা শুধু জীবিকার জন্যও নয়।গান্ধীজী শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে বলেছেন।শিক্ষা তথা জ্ঞান নির্ভর করে স্থান কাল ও পরিবেশের উপর।
জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০২০ খুটিয়ে পড়লে দেখা যাবে এই শিক্ষানীতি যেন শিক্ষা নিয়ে গান্ধীজীর স্বপ্ন পূরণের জন্যই তৈরী হয়েছে।গান্ধীজী প্রস্তাবিত শিক্ষার উদ্দেশ্য ও বুনিয়াদি শিক্ষার সমস্ত বৈশিষ্ঠই এই শিক্ষানীতির মূল চালিকা শক্তি।জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০২০ Child Centred,Life Centred, Craft Centred and Self-Sufficient যা কিনা গান্ধীজী প্রস্তাবিত বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্টের সাথে হুবহু মিলে যায়। গান্ধীজী প্রস্তাবিত অবৈতনিক বাধ্যতা মূলক এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কথা এই শিক্ষা নীতিতেও বলা হয়েছে। গাঁধীজি, শিক্ষার মূল স্রোতের সঙ্গে কারিগরি বা বুনিয়াদি বিদ্যাকে যুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন।বর্তমান শিক্ষানীতিতেও মূল স্রোতের শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার মধ্যে ভেদ রেখা তুলে দেওয়া হয়েছে।শিক্ষানীতির ৪.২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে ,' Every student will take a fun year-long course , during Grades 6-8, that gives a survey and hands-on experience of a sampling of important vocational crafts ,such as carpentry,electric work, metal work , gardening , pottery making etc., as decided by States and local communities and as mapped by local skilling needs.' শিক্ষানীতির ৪.২৪ ধারায় বলা হয়েছে ,' Concerted curricular and pedagogical initiatives,including the introduction of contemporary subjects ,such as Artificial Intelligence , Design Thinking ,Holistic Health, Organic Living, etc. at relevant stages will be undertaken to develop these various important skills in students at all levels.'
গান্ধীজীর ভাবনা অনুসারে স্থানীয় শিল্প বা দক্ষতা এবং নিজস্ব রুচি অনুসারে কোন একটি বিষয় হাতে কলমে প্রশিক্ষিত হয়ে শিক্ষার্থী স্কুলের শিক্ষা সমাপ্ত করবে।গান্ধীজীর ভাবনা অনুসারে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিকেও ক্রমান্বয়ে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে।
কেন্দ্র সরকারের নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি সংক্রান্ত একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো, কলকাতা। এই নীতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহ-অধ্যক্ষ স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ বলেন, এই শিক্ষানীতি স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্ন পূরণ করবে।স্বামীজি স্বপ্ন দেখতেন প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মেলবন্ধন। নতুন শিক্ষানীতিটি সেই ভাবনারই প্রতিফলন। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করে স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ বলেন, নতুন শিক্ষানীতিটি শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, পুনর্সমন্বয়সাধন, সমৃদ্ধকরণের সঙ্গে তাতে প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে।শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক (ডঃ) বিপ্লব লোহচৌধুরী বলেন, এই শিক্ষানীতি শিক্ষকদের প্রকৃত যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করে দেবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম, রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অনুসরণ করে শিক্ষকদের মর্যাদাকে গুরুত্ব সহকারে সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এই প্রথম, হস্তশিল্পী, কৃষক, তন্তুবায়-সহ চিরাচরিত বিভিন্ন পেশার মানুষকে শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা এখন থেকে প্রস্তাবিত ক্লাস্টার স্কুলে ক্লাস নিতে পারবেন।
সবমিলে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায় স্বাধীনতার সত্তর বছর পরে হলেও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষা নিয়ে গান্ধীজী,স্বামীজী , রবীন্দ্রনাথের মতো মনীষীদের স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন