![]()  | 
| ::::বড়দেবী:::: | 
সাধনকুমার পাল::বর্তমানে যে সকল দেবীর উপাসনা ও উৎসব বাংলার হাজার হাজার বছরের শক্তি আরাধনার পরম্পরা অপরিবর্তিত রেখে এখনও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হলো কোচবিহারের রাজগৃহের কুলদেবী বড় দেবীর আরাধনা। বড় দেবী হলেন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের রাজবাড়ীর কূলদেবী। তিনি উত্তরবঙ্গের হিন্দু সমাজের মধ্যে অত্যন্ত জাগ্রত দেবী হিসেবে পুজিতা হয়ে থাকেন।কিংবদন্তি অনুসারে কোচবিহারের বড় দেবীর আরাধনা আনুমানিক ৪০০ বছরের পুরনো। বিশু অর্থাৎ কোচবিহার রাজবাড়ীর তৎকালীন রাজা বিশ্বসিংহ স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে বড় দেবী এর উপাসনা শুরু করেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে রাজবাড়ীর মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গনে ময়না গাছের ডাল পুঁতে দেবীপুজো শুরু করেন।
এই মন্দির দেবী বাড়ি হিসেবে গোটা কুচবিহারে পরিচিত। মন্দিরে কোন স্থায়ী বিগ্রহ নেই। মন্দিরের বশিষ্ট্য হলো 30 ফুট এর চাইতেও উঁচু মন্দির। এই মন্দিরের দুর্গা প্রতিমার সম্পর্কে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। জনশ্রুতি এমন মহারাজা নর নারায়ণের ভাই রাজা হবার জন্য দাদাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে তিনি দেখেন স্বয়ং ভগবতী নর নারায়ণ কে কোলে ধারণ করে আছেন।শুকনো দজ অপরাধবোধে দাদার পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেন।
প্রত্যেক বছর শারদীয়া দুর্গাপুজো চলাকালীন মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে বড় দেবীর মন্দির প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় গুপ্তপুজা । তখন মন্দিরে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ থাকে। মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ থাকে। শুধুমাত্র রাজ পুরোহিতগণ ও রাজপরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতেই এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। শোনা যায়, আগে গুপ্তপুজোর সময় নরবলি হত। এখন সে প্রথা বিলুপ্ত। কিন্তু, এখনও প্রত্যেক বছর মায়ের পুজোয় নররক্ত লাগে। তাই প্রত্যেক বৎসর গুপ্তপুজো চলাকালীন রাজপরিবারের মধ্যে একজন নিজের আঙ্গুল থেকে কিছুটা রক্ত দেবীর পদতলে উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। আগে মহাষষ্ঠি থেকে নিয়মিত বলি হত, ২৫০ বছর আগে রাজা নরনারায়ন এই নরবলির প্রথার বিলুপ্তি ঘটান।
বড় দেবীর রূপ অত্যন্ত ভীতিপ্রদ। দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর গাত্রবর্ন লাল, অসুরের গাত্রবর্ন সবুজ। দেবীর বাহন সিংহরাজ অসুরের এক পায়ে কামড়ে ধরেছে, অসুরের অপর দিকে হাতে কামড়ে ধরেছে ব্যাঘ্র। দেবীর দুই পাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া। তাদের হাতে রয়েছে জ্বলন্ত মশাল।
প্রত্যেক বৎসর মহাঅষ্টমীর পুজোয় অসংখ্য পাঁঠা, কবুতর ও মহিষ বলি দেওয়া হয়। নরবলির প্রথা বিলুপ্ত হলেও নররক্তে আজও সন্ধিপূজো হয়ে আসছে। জনশ্রুতি আছে, আজ হতে ৫০০ বছর পূর্বে রাজা নরনারায়ন তার শৈশবে একদিন বন্ধু সাথে পুজো পুজো খেলতে গিয়ে, এক বন্ধুকে পাঁঠা সাজিয়ে গাছের ডাল দিয়ে কাল্পনিক বলি দিতে গেলে সত্যি বলি হয়ে যায়। রাতে রাজা মহিষাসুরমর্দিনী দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। সেই দিন থেকেই শুরু হয় নরবলির প্রথা।ষষ্ঠি থেকে আরম্ভ সহকারে পুজো হলেও মায়ের ভোগে থাকে শুধুই পায়েস। নবমীর দিন চাল, ডাল, সবজি ও বলির মাংস একত্র করে অভিনব ও এক বিশেষ আমিষ খিচুড়ি মায়ের প্রসাদে দেওয়া হয়। অঞ্জলি হওয়ার পর সবাই সেই ভোগ গ্রহণ করে। প্রথমে জেলা শাসক, জেলার সরকারি কর্মচারী ও রাজবাড়ীর লোকেরা অঞ্জলি প্রদান করেন এবং পরে বাকিরা। এটাই রাজবাড়ীর দীর্ঘদিনের প্রথা।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন