সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজয়া দশমীতে শস্ত্রপূজন তাৎপর্যপূর্ণ

সাধন কুমার পাল 1. পুরাণে কথিত আছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ও ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে জয় লাভ করেন দেবী দুর্গা। সেই জয়কেই চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী। তবে উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য ভিন্ন। বাল্মীকি রচিত রামায়ণে কথিত আছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের দশমী তিথিতেই নাকি রাবনকে বধ করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। তাই এই দিনটিকে দশেরা বা দশহরা হিসেবে পালন করেন উত্তর ও মধ্য ভারতের মানুষ। 

 2. শাস্ত্রজ্ঞরা জানাচ্ছেন, সংস্কৃত ‘দশ’ শব্দের অর্থ সূর্যের অনুপস্থিতি এবং ‘হর’ শব্দটির অর্থ ‘পরাজয়’। লঙ্কাধিপতি রাবণের সাম্রাজ্যের সূর্যাস্তকে বোঝাতে দশহরা বা দশেরা বলা হয়। একই সঙ্গে ‘বিজয়া দশমী’ দুর্গার হাতে মহিষাসুরের পরাভবকেও ব্যক্ত করে। মহিষাসুরই হোক বা রাবণ-- এই দিনটি আসলে অশুভ শক্তির পরাজয়কে মনে করায়।

 3. দশহরা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকেও। দশ + অহ = দশারহ = দশহরা। ‘অহ’ শব্দের অর্থ দিন। ৯ রাত্রি ১০ দিন ধরে অবিরাম লড়াইয়ের পর দুর্গা দশম দিনে মহিষাসুরকে বধ করেন। সুতরাং এই দিন দেবীর জয়ের দিন। সে জয় ভারতবাসী উদ্‌যাপন করেন দেবী দুর্গার পুজো করে। 

4. আসলে দশেরা হল, দেবীপক্ষের দশম দিন বা নবরাত্রির দশম দিন। যে আসলে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই বিশেষ দিনটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে ১০ সংখ্যাটি। সেইসঙ্গে অবশ্যই ‘বিজয়’-এর প্রসঙ্গও জড়িত। এই দিন লঙ্কায় দশানন রাবণকে হারিয়ে রাম যুদ্ধ জয় করে সীতা উদ্ধার করেছিলেন। স্থানীয় ভাষায় দশহরা শব্দের অর্থও তা-ই। দশ মানে দশানন রাবণ, আর হরা মানে হার। 

5. দশেরা বিজয়ের উৎসব।সেই জন্য এইদিন রাজা-মহারাজারা বিশেষ রীতিনীতিতে পালন করতেন। এটি বিজয় এবং বীরত্বের অনুষ্ঠান! মহাভারতে উল্লেখ আছে অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার আগে অর্জুন তাঁর সমস্ত অস্ত্রসস্ত্র গুলিকে একটি শমীগাছের কোটরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরে যখন কৌরবরা বিরাট রাজার গোশালা লুঠ করতে আসে তখন অর্জুন সেই কোটর থেকে অস্ত্রশস্ত্র বের করে করে এনে কৌরবদের পরাজিত করেন। 
            
6. উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। 'দশেরা' শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'দশহর' থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কথিত আছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ। রাবণ বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যেই যুথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। 
                                           

                    

7. তবে দুর্গাপুজোর শেষ দিন হিসাবে দশমী শোকের ছায়া বহন করলেও শাস্ত্রে এই বিষয়টিকে সেই ভাবে দেখা হয়নি। এপ্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। রানী রাসমণীর জামাতা মথুরবাবু একসময় আবেগপ্রবন হয়ে দশমীর দিনেও মা দুর্গাকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান, বিজয়ার অর্থ দেবীমা ও সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। তিনি আরও বলেন যে, মা কখনও তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। এতদিন মা দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এরপর মা হৃদয়মন্দিরে বসে পুজো নেবেন। এরপরেই মথুর শান্ত হন এবং বিসর্জন হয় মা দুর্গার প্রতিমা। 
                                                                          
8. সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বকে অনুসরণ করলে দেখা যাবে, বছরের প্রধানতম ফসলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে সম্বৎসরের আশা-আকাঙ্ক্ষা। নবরাত্রি অথবা চারদিনের দুর্গোৎসব এই আকাঙ্ক্ষারই রূপায়ণ ঘটায় নববস্ত্রে, উদ্‌যাপনে।

 9. ভারতীয় আধ্যাত্মভাবনাতেও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে এই দিনটি। রাবণ কৃত অসৎ কর্মগুলিকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করতেই যেন প্রতীকী রাবণ-দহন পালিত হয় এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অহঙ্কার এবং দর্পের প্রতিমূর্তি রাবণকে সংহার করে এক বিনম্র জীবনকে বেছে নেওয়ার কথাও বলে দশেরা উৎসব। 

10. কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড ও পশ্চিম বিহারে নবরাত্রির প্রথম দিনে মাটির টবে বার্লির বীজ পুঁতে দেওয়া হয়। বীজ থেকে যে অঙ্কুর বেরোয়, নয় রাত্রির পর দশম দিনে পুরুষেরা তা তাঁদের টুপিতে পরেন বা কানের পিছনে লাগিয়ে রাখেন। এই অঙ্কুরকে সৌভাগ্যের প্রতীক ভাবা হয়। গোটা উত্তর ভারত ও মহারাষ্ট্রের একাংশে রামের সম্মানে দশেরা পালন করা হয়। রামের বিজয়ের দিনটি এঁরা পালন করেন রাবণ পুড়িয়ে।হিমাচলের কুলু দশেরার কথা আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। কুলু শহরের ঢোলপুর ময়দানে যে মেলা বসে তাতে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা ভিড় জামান। মহীশূরে দশেরা উদ্‌যাপন হয় মহিষাসুরমর্দিনীর বিজয়কে স্মরণ করে। এখানকার দশেরা মিছিলের খ্যাতি জগৎ জোড়া। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য সর্বত্রই বিজয়াদশমী পালিত হয়। তবে প্রতিটি জায়গাতেই সেখানকার অনুষ্ঠানের স্থানীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। 
11. ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিন ডা: কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএসের) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে প্রতি বছর ছয়টি পালনীয় উৎসবের মধ্যে বিজয়া দশমী উৎসব একটি। আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত ভারতকে শক্তি আরাধানার ঐক্য সূত্রে গেথে রেখেছে এই উৎসব । ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই রাস্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এই উৎসবটিকে পালন করে থাকে। শক্তির আরাধনার প্রতীক হিসেবে এই দিনে শস্ত্রপূজন হয়।এই শস্র পূজনের উদ্দেশ্য ধর্মসংস্থাপনার্থায় পরিত্রাণায় সাধুনাং এবং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং । সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই শস্ত্র পূজন প্রথা নিয়ে নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ বিতর্ক তৈরীর প্রয়াস করেণ। ক।ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে এই ধরণের বিতর্ক তোলা কোন ভাবেই কাম্য নয়। বরং শাস্ত্র শাসিত শস্ত্র জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। 
 12. ১৯০৯ সালে বীর সাভারকারের হাত ধরে লন্ডনে প্রথম বিজয়া দশমী পালিত হয়। রামচন্দ্রের কাজকে স্মরণ করে তিনি বলতেন, ” শ্রীরামচন্দ্রের সিংহাসন ত্যাগের আপাত কারণ যদিও ছিলো পিতৃসত্য রক্ষা, কিন্তু তার আসল কারণ ছিলো রাক্ষস দমন। যখন তিনি লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণ হত্যার জন্যে ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর ভূমিকা ছিলো গৌরবোজ্জ্বল।” শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বীর সাভারকারের ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। তিনি এই দুইজনকে দেশের প্রধান সেনাপতি এবং সর্বাধিনায়ক বলে উল্লেখ করতেন। 

 13. 'দশমী' কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটা বছর। সাধারনত দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃ গৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী। সেই কারণেই এই তিথিকে 'বিজয়া দশমী' বলা হয়।দেবী দুর্গার বিদায়ের দিনে বিষাদের সুরেই বিজয়া দশমী পালন করে মর্ত্যবাসী। সধবা মহিলারা সিঁদূর খেলায় মেতে ওঠেন। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় মানবকুল। চলে মিষ্টিমুখ। বিশ্ব সংসারে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। আর এখানেই বিজয়া দশমীর বিশেষত্ব অন্যরকম বলে মনে করা হয়। ###

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...