সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আত্মঘাতি বাঙালির বিস্মৃতির অতলে ২০ জুন,পশ্চিমবঙ্গ দিবস

                      সাধন কুমার পাল

       ২০শে জুন, পশ্চিমবঙ্গ দিবস। সেটা আবার কি ধরণের দিবস? আমাদের অনেকেই জানি না, কারণ এই ইতিহাসটা পরিচিত ইতিহাসের মধ্যে পরে না। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাস নাগাদ জিন্নার প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাছে পরাজয় স্বীকার করে , মাউন্টব্যাটেনের কূটনীতির জালে ফেঁসে ক্ষমতার লোভে মোহগ্রস্থ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগ স্বীকার করে নিলেন। একবার ভেবে দেখলেন না, সীমান্তের ওপারে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে যে সব হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান তাদের কি হবে | সে সময় অবিভক্ত বাংলা ছিল ৫৫% মুসলিম, ৪৫% হিন্দু। মুসলিম লীগ দাবি তুলল যে গোটা বাংলাই পাকিস্তানকে দিতে হবে। এটা হলে আসামও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত এবং কালক্রমে সেটাও পাকিস্তানে চলে যেত। কিন্তু এই চক্রান্ত বিফল হল শুধু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের  জন্য। তিনি তাঁর বিশাল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ইসলামী পাকিস্তান হিন্দুদের জন্য নরকে পরিণত হবে। সেইজন্য তিনি দাবী করলেন, ভারত ভাগ করলে বাংলাকেও ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে একটা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টি করতে হবে, যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অংশ। এই বিষয়ে প্রচার করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ সারা বাংলা চষে বেড়ালেন পেলেন কংগ্রেসেরও সমর্থন। 

সেই সময়কার বাঙালি হিন্দু মনীষীরা, যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদা প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ তাঁকে অকুন্ঠ সমর্থন করলেন। এই সমর্থনের জোরে বঙ্গীয় আইনসভা বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব পাশ করল। শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্ঠায় ৫৪ জন বিধায়কের প্রবল দাবির কাছেই পশ্চিমবঙ্গ স্বীকৃতি পেয়েছিল ।সে দিনটা ছিল ২০শে জুন ১৯৪৭। শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের অংশ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে সিলমোহর পড়ে।সেই পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল বলে আমরা বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের ভূমি পেয়েছিলাম। ইসলামী রাষ্ট্রে জিম্মি হয়ে থাকতে হয় নি। সে জন্য এই দিনটিতে শতকোটি প্রণাম পশ্চিমবঙ্গের 'জন্মদাতা' শ্যামাপ্রসাদের চরণে।

      জন্মদিন পালনের রীতি অনুসরণ করে সরকারী উদ্যোগেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ধুমধাম করে তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয়।রাজ্য সৃষ্টির কারিগরদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই বিভিন্ন উপস্থাপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজ্য তাদের কৃষ্টি , সংষ্কৃতি , সামাজিক ও ভৌগলিক বৈশিষ্ট, গৌরবময় ইতিহাস বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার প্রয়াস করে থাকে।ব্যাতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ।এই রাজ্যের সৃষ্টি ও স্রষ্টা নিয়ে রাজ্যবাসীর মধ্যে সামান্যতম আবেগ বা সামাজিক চেতনাও যেন নেই ।কিন্তু কেন? এটা কি আত্ম সচেতনতার অভাব না সচেতন ভাবে ইতিহাস কে ভুলে থাকার প্রয়াস ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রযোজন। কারণ ইতিহাস বলছে ইতিহাস কে অস্বীকার করে বা ভুলে গিয়ে কখনই গৌরববয় ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব নয়।সাড়ে পাঁচশ বছরের ইসলামী শাসন বাংলার কয়েক হাজার বছরের ধর্ম সংস্কৃতি ভাষাকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। বাংলায় তাই নেই কোনও প্রাচীন মন্দির, বৌদ্ধ বিহার। বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণে হিন্দু-বৌদ্ধের বাংলাকে বানানো হয়েছে ইসলাম প্রধান বাংলা।

১৮৭২ সালের প্রথম জনগণনার পর সরকারীভাবে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দুর চেয়ে কিছু বেশী। ১৯৩১ পর্যন্ত এ পার্থক্য তেমন বেশি ছিল না। ৫৫ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু এই সুযোগেই ব্রিটিশ সরকার আনল ১৯৩৫ সালের সাম্প্রদায়িক চুক্তি বা কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড। বাংলার আইনসভায় মুসলমান আসন হল ১৩০ টি। হিন্দু আসন, তফসিলি আসন মিলিয়ে, মাত্র ৯০।

      এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাঃ নীলরতন সরকার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা। তাঁদের বিবৃতিতে তাঁরা খুব স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে সংখ্যায় মুসলমানরা বেশি হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ব্যাবসা বানিজ্য সবকিছুতেই হিন্দুরা অনেক এগিয়ে। সুতরাং বাংলার ভালমন্দের সিদ্ধান্ত কেবল জনসংখ্যার মানদণ্ডে হতে পারে না। বাংলার কংগ্রেস, বিশেষতঃ সুভাষচন্দ্র বসু, এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।

       ১৯৩৫-এর কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড মেনে ১৯৩৭-এর নির্বাচন থেকে শুরু হল আবার মুসলিম লিগের ইসলামী শাসন। স্বাধীনতা ও দেশভাগের আবহাওয়ায় তপ্ত হয়ে উঠল বাংলায় ইসলামী অত্যাচার। ১৯৪৬-এর কলকাতার মহাদাঙ্গা ও নোয়াখালীর হিন্দু গণহত্যার পর বাঙালি হিন্দু বুঝে গেল আগামী দিনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় তাদের অবস্থা কী হবে।

     ১৯৪৬।শেষ হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।প্রত্যাহত হল ভারত ছাড়ো আন্দোলন।জওহরলাল নেহেরু সহ জেল ফেরত রণক্লান্ত কংগ্রেস নেতারা তখন ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে দেশের শাসন ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার স্বপ্নে মশগুল।শীর্ষ কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে তখন গান্ধীজী গুরুত্বহীন মার্গ দর্শক মাত্র। পুরো বাংলা ও পাঞ্জাকে পাকিস্থানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবী নিয়ে জিন্না অনেক আগেই মাঠে নেমেছেন।দাবী পূরণের জন্য ১৬ আগষ্ঠ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হল।হিন্দু বিরোধী দাঙ্গায় রক্ত স্রোত বইল কলকাতা ও নোয়াখালির মাটিতে। অখন্ড ভারতের পূজারী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বুঝলেন দেশ ভাগ রোখা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলার কিছুটা অংশ ভারতের দিকে রেখে দিতে সচেষ্ঠ হলেন।দাবী তুললেন মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রদেশ নিয়ে যদি দেশ ভাগ করা যেতে পারে তাহলে হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ জেলাগুলি নিয়ে সেই প্রদেশগুলি ভাগ করে নতুন প্রদেশ গঠন করে তা ভারতের সাথে যুক্ত করা হবে না কেন?

    জনসংখ্যার হিসেবে সে সময় বাংলার পশ্চিমভাগ ও পাঞ্জাবের পূর্বভাগের জেলা গুলি হিন্দু প্রধান।জিন্নার দাবি মতো সংখ্যা গরিষ্ঠতার প্রশ্নে প্রদেশ কে ধরা হয়েছিল ইউনিট।শ্যামাপ্রসাদ প্রশ্ন তুললেন ভৌগলিক অবস্থান , আঞ্চলিক সংলগ্নতা ও সংখ্যা গরিষ্ঠতার প্রশ্নে জেলা ও থানা কে ইউনিট ধরে কেন ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। 

সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার ল্যাবরেটরিতে ছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কার্যালয়। শ্যামাপ্রসাদ অধ্যাপক প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম জনসংখ্যার ডিসট্রিবিউশন দেখিয়ে পরিসংখ্যান সহ একটি বিশদ মানচিত্র প্রস্তুত করে দিতে বলেন।অধ্যাপক মহলানবিশ অক্লান্ত পরিশ্রম , অত্যন্ত যত্ন ও সতর্কতার সাথে প্রতিটি প্রদেশের জেলা ভিত্তিক হিন্দু ,মুসলমান ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর পরিসংখ্যান গত ডিস্ট্রিবিউশন দেখিয়ে একটি সুদৃশ্য ম্যাপ সহ রিপোর্ট প্রস্তুত করে দেন। রিপোর্টটির হেডিং দেন ' ডিস্ট্রিবিউশন অফ মুসলিম ইন দি পপুলেশন অফ ইন্ডিয়া -১৯৪১'

   এই রিপোর্টটি আই এস আই এর মুখপত্র 'ইন্ডিয়ান জোনাল অফ স্ট্যটিসটিকস'এ প্রকাশিত হয়েছিল।কংগ্রেসের অদুরদর্শিতার জন্য হিন্দুরা ১৯৪১ এর সেন্সাস বয়কট করলেও মুসলিম লিগের তৎপরতার জন্য মুসলমানরা সঠিক ভাবে তাদের সংখ্যা নথিভুক্ত করিয়ে ছিল।স্বাভাবিক ভাবেই ১৯৪১এর সেন্সাস কে ভিত্তি করে অধ্যাপক মহলানবিশের তৈরী রিপোর্টে হিন্দু জনসংখ্যার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে নি। সেদিন জন বিভাজনের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠলে আজকের পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র অন্য রকম হতে পারতো। ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ম্যাপ সহ বিস্তারিত তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে বাংলা ও পাঞ্জাব কে ভাগ করে হিন্দু ও শিখ সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল কে ভারতের সাথে যুক্ত করার পক্ষে অকাট্য যুক্তি সম্বলিত এক মেমোরেন্ডাম তৈরী করে ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মাধ্যমে বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করেণ।শ্যামাপ্রসাদের পেশ করা তথ্য নৈপুন্য , অকাট্য যুক্তির কাছে সেদিন বৃটিশ সরকার নতি স্বীকার করে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন এবং জিন্না ও মুসলিম লিগকেও এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন। 

        ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সেদিন এক অসাধ্য সাধন করেছিলেন।কারণ জিন্না যখন বুঝলেন দেশভাগ হলেও পুরো বাংলা তিনি পাবেন না তখন তিনি কলকাতা দাঙ্গার নায়ক সুহরাওয়ার্দিকে কে উস্কে দিলেন। সুহরাওয়ার্দি ঘোষনা করলেন বাংলা ভাগ নয় তিনি 'স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা' চান ।জিন্না এই প্রস্তাব কে 'উত্তম প্রস্তাব' বলে সমর্থন করে জানিয়ে দিলেন 'স্বাধীন বাংলা' হলে তারা পাকিস্থানের প্রতি সম মনোভাবাপন্ন আরেকটি রাষ্ট্র পাবেন। দু:খজনক হলেও সুহরাওয়ার্দি এই দাবির সপক্ষে কিরণশঙ্কর রায় ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু কে পেয়ে গেলেন। সে সময় কংগ্রেসে ডা: বিধান চন্দ্র রায় , নলিনীরঞ্জন সরকার ও নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের আধিপত্য।ফলে এই দুজন রাজনীতিতে অনেকটাই অপ্রসঙ্গিক হয়ে পরেছিলেন। হতে পারে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতেই যুক্ত বঙ্গের প্রস্তাব নিয়ে কিরণশঙ্কর ও শরৎচন্দ্র সক্রিয় হয়ে উঠে ছিলেন। শরৎচন্দ্র বসু ও মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম 'স্বাধীন বাংলা'র জন্য তড়িঘড়ি একটি অস্থায়ী সংবিধানও লিখে ফেললেন।মতামতের জন্য অস্থায়ী সংবিধানটি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে পাঠালেন।জবাবে সর্দার প্যাটেল অত্যন্ত কড়া ভাষায় শরৎচন্দ্র বসু কে লিখলেন ' আমি দেখছি তুমি নিজেকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছ।' গান্ধীজী সুহরাওয়ার্দিকে কে প্রশ্ন করেছিলেন 'তুমি কি এই অঙ্গীকার তোমার সংবিধানে ঢোকাতে পার যে এই রাষ্ট্র কখনই পাকিস্থানে যোগ দেবে না?' এই প্রশ্নের মুখে সুহরাওয়ার্দি ছিলেন নিরুত্তর।

       এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করে ১৯৪৭ এর ১১মে শ্যামাপ্রসাদ নেহেরু ও প্যাটেল কে চিঠি লিখে জানান যে সুহরাওয়ার্দি, শরৎচন্দ্র বসু ও হাশিমের ক্রিয়াকলাপে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।তিনি আরো লেখেন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবের পেছনে হিন্দুদের কোন সমর্থন নেই।শরৎ বসুর রাজনৈতিক গ্রহন যোগ্যতা এতই তলানীতে যে আজকাল তিনি কোন সভা সমিতিতেও বক্তৃতা করেন না। শরৎচন্দ্র বসু ,সুহরাওয়ার্দি, ও আবুল হাশিমের যুক্তবঙ্গের পরিকল্পনাকে বানচাল করার জন্য সে সময় শ্যামাপ্রসাদ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।এই পরিশ্রমের ফলেই নাড়া দিতে পেরেছিলেন বাংলার হিন্দু জনমত কে।১৯৪৭ সালের মে মাসে অমৃত বাজার পত্রিকায় বেরোল যে বাংলার ৯৭ শতাংশ হিন্দু বাংলা ভাগ চান।সমস্ত জল্পনার অবসান হলো।১৯৪৭ এর ৩ জুন অ্যাটলি বৃটিশ পার্লামেন্টে একটি ঘোষনা দাখিল করে জানালেন যে ভারতের সাথে সাথে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশকেও ভাগ করা হবে।

       এরপর ২০ জুন বাংলা বাংলার আইন সভা বাংলার ভাগ বিষয়ক প্রস্তাব পাশ করলো।জন্ম নিলো আজকের পশ্চিমবঙ্গ। সেদিনের এই বঙ্গভঙ্গের ভাবনার দুরদর্শিতা প্রমাণ হলো ১৯৪৭ এর পর।যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বস্ব খুইয়ে নি:স্ব হয়ে শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে লক্ষ লক্ষ হিন্দু আশ্রয় নিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ সৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গে। পুরো বাংলা যদি পাকিস্থানে চলে যেতো অথবা মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ(হিন্দু:মুসলিম::৪৭:৫৩) 'স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা' তৈরী হতো তাহলে পাকিস্থানে হিন্দুদের যে অবস্থা হয়েছে ঠিক একই অবস্থা হতো বাংলার সাড়ে তিন কোটি হিন্দুর।য়ারা বেঁচে থাকতেন তাদের ভিক্ষাজীবী হয়ে আশ্রয় নিতে হতো বিহার উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশের দন্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু শিবিরে।বাঙালী হিন্দুর কপালে যে ঐ ভয়ংকর অভিশাপ নেমে আসেনি তার সম্পূর্ন কৃতিত্ব ডশ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর।

    সাম্প্রদায়িক তকমা লাগার ভয়ই হয়তো সাম্প্রদায়িকতার পাঁকে জন্ম নেওয়া আজকের ধর্মনিরপেক্ষ রাজ্যটির বাসিন্দাদের তাদের নিজের রাজ্যের সৃষ্টির ইতিহাস ও স্রষ্টা শ্যামাপ্রসাদ কে স্মরণ করতে না চাওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ।উৎসব প্রিয়, ভোট প্রিয় , 'বেশ থাকা ' 'ধর্মনিরপেক্ষ' বাঙালী নিজের আশ্রয়দাত্রী রাজ্যটির ধর্ম ভিত্তিক জন্ম কথা স্মরণ করতে হয়তো সংকোচ বোধ করেণ। সন্দেহ নেই এটি একটি আত্মঘাতি প্রবণতা।ইতিহাস বলছে এই আত্মঘাতী মানসিকতা কাটিয়ে উঠে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের চলার পথ তৈরী করতে না পারলে আবার বিপন্ন হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর ভবিষ্যত সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার তকমাও।

জগদীশ  ধনখড় বাংলার রাজ্যপাল থাকাকালীন ওই দিনটি প্রতি বছর পালিত হত রাজভবনে। জগদীশ ধনখড়ের ইস্তফার পর লা গণেশন যখন অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব পান, তিনি ওই দিনটি পালনের সুযোগ পাননি। বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করবেন।

 ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস উদযাপন এই ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার। কেউ বলছেন, আমরা বাংলায় বিভাজন করছি। বিভাজন তো হয়ে গেছে আজ থেকে আটশো বছর আগে যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আগুনে পুড়িয়ে বখতিয়ার খিলজি বাঙলায় ঢুকল। তারপর থেকে বাঙলার একটিও পুরনো মন্দির আর দাঁড়িয়ে নেই। যতদিন ত্রিবেনীর জাফর খানের মসজিদ, আদিনার মসজিদ অপসারিত না হচ্ছে ততদিন বিভাজন তো থাকবেই।

পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করাই আমাদের প্রাথমিক কাজ। আজ খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হবে বাংলায় কথা বললেই সে বাঙালি নয়, তাকে পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার উত্তরাধিকারও স্বীকার করতে হবে। বাংলাভাষী ও বাঙালি এক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু আজ বহন করছে সেই উত্তরাধিকারের দায়িত্ব। পারসী, সিন্ধি, কাশ্মিরী পণ্ডিতদের আজ আর নিজেদের দেশ নেই, তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন ভারতের বিভিন্ন কোণে, হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি।পশ্চিমবঙ্গকে পাকিস্তান বানাতে ইসলামী মৌলবাদী শক্তি নাগরিকত্ব আইন ও এনারসির বিরোধিতায় রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ে ২০১৯ সালের ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর সারা বাংলা জুড়ে হিংসাত্মক তান্ডব চালায়। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গকে আমরা ধ্বংস করতে দেব না। সেজন্যই আজ প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝা ও দিকে দিকে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা।##




 





মন্তব্যসমূহ

  1. Asadharan lekha। Akti দলিল হিসেবে কাজে লাগবে।
    বর্তমান ছাত্রদের এই ইতিহাস জানানো দরকার।

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ লেখা
    আমাদের এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত ও সকলের সাথে চর্চা করার প্রয়োজন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...