সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পহেলা বৈশাখে বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বাকে হাইজ্যাক করার অপপ্রয়াস

সাধন কুমার পাল::::বাংলা ভাষার আরবীকরণ থেকে শুরু করে, আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি দেওয়া, খন্ডিত পূর্ববঙ্গকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ, ‘হাজার বছরের বাঙালি’ তত্ত্ব, সনাতন ঐতিহ্য বর্জিত নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রণয়ন এই সবই বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বাকে হাইজ্যাক করার এক একটি মাইলফলক। এই প্রচেষ্টার সাফল্যের জোরেই আজ পশ্চিমবঙ্গে বাঙ্গালীদের বিশ্বাস করানোর প্রয়াস হচ্ছে আকবরই বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা।এক দশক আগেও কিন্তু এমনটা শোনা যেত না। ২০০৫-এ প্রকাশিত ‘দ্য আগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইতে স্বয়ং অমর্ত্য সেন এই দাবীটি করেন। এরপর বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি এইটি বলতে শুরু করেন। ক্রমে এটি চালু হয়ে যায়। গুগুল কে প্রশ্ন করলেও উত্তর আসবে ‘বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা আকবর’।
           আকবরপন্থীদের বক্তব্য , খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর তারিখ-ই-ইলাহী নামে একটি সৌর বর্ষপঞ্জী চালু করেন। কিন্তু তার ভিত্তিবর্ষ ছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, আকবরের শাসনকালের প্রথম বছর। অর্থাৎ তারিখ-ই-ইলাহী শুরুই হয় তার ২৯তম বর্ষ থেকে। ওদিকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৬৩ হিজরী। আকবরপন্থীদের মতে ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দকে ৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে তারিখ-ই-ইলাহীর সাথে সাথে বঙ্গাব্দও চালু করেন আকবর। অর্থাৎ বঙ্গাব্দ শুরু হয় তার ৯৬৩ + ২৯ = ৯৯১তম বর্ষ থেকে। চান্দ্রবর্ষ হওয়ায়, হিজরী ততদিনে আবার এক বছর এগিয়ে গেছে। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ ছিল ৯৯২ হিজরী। কিন্তু সত্যিই কি আকবর ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ চালু করেছিলেন ? 
         প্রকৃত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে অমর্ত সেন বা আকবর পন্থীদের এই বঙ্গাব্দের শ্রষ্ঠা বানানোর প্রয়াস ধোপে টিকে না।
          প্রথমত, ‘আইন-ই-আকবরী’-তে ৩০ পাতা জুড়ে বিশ্বের ও ভারতের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর কালানুক্রমিক বিবরণ রয়েছে। সব শেষে রয়েছে তারিখ-ই-ইলাহী। কিন্তু ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’-এর কোনো উল্লেখ নেই। আকবর যদি সত্যিই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ প্রবর্তন করতেন, তাহলে আইন-ই-আকবরীতে তার উল্লেখ থাকবে না, কেন?
      দ্বিতীয়ত, আকবরের শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্যে বাংলা, ইলাহাবাদ, অযোধ্যা, আগ্রা, পাটনা, কাবুল ইত্যাদি মোট বারোটি সুবা ছিল। তাহলে আকবর শুধুমাত্র বাংলার জন্য পৃথকভাবে বিশেষ একটি বর্ষপঞ্জী তৈরি করতে গেলেন কেন? কাবুলের জন্য তিনি কোনো পৃথক বর্ষপঞ্জী তৈরি করেননি কেন? 
    তৃতীয়ত, 'আইন-ই-আকবরী’-তেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আকবর হিজরী সন পছন্দ করতেন না, তাই তিনি তারিখ-ই-ইলাহীর সূচনা করেন। সেই সঙ্গে তিনি যদি সত্যিই বঙ্গাব্দের সূচনা করতেন তার ভিত্তিবর্ষ নিজের প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী সাথে সমান না রেখে অপছন্দের হিজরীর সাথে মেলাতেন কি? 
    চতুর্থত, পাঞ্জাব থেকে দাক্ষিণাত্য, গুজরাত থেকে অসম, মণিপুর, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া হয়ে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যেখানেই ভারতীয় সংস্কৃতি পৌঁছেছে, সকল জায়গাতেই বর্ষ শুরু পয়লা বৈশাখে। তাহলে কি বলতে হবে দিল্লির আকবর এই সকল জায়গায় ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেছিলেন?‘আইন-ই-আকবরী’-তে ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’-এর যেমন উল্লেখ নেই, তেমনই উল্লেখ নেই ‘ফসল-ই-শান’ বা ‘ভাল ফসলের বছর’-এর। হিজরী সন চান্দ্র বর্ষপঞ্জী হওয়ায় অসময়ে রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে এবং তার জন্যই সৌর বর্ষপঞ্জী প্রণয়ন করেন আকবর এমন উল্লেখও নেই সেখানে।         
          পঞ্চমত,নীতিশ সেনগুপ্তর বই ‘দ্য ল্যান্ড অফ টু রিভার্স’-এ উল্লেখ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার ডিহারগ্রাম ও সোনাতপন গ্রামের হাজার বছরেরও প্রাচীন টেরাকোটার শিব মন্দিরের। ওই মন্দির দু’টির গায়ে বঙ্গাব্দের কথা খোদিত রয়েছে, যা আকবরের থেকেও প্রাচীন। আকবর বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন, অমর্ত্য সেনের এই বক্ত্যের ভিত্তি কী? ১৯৬০-এর দশকের পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারী ভাষা তখন বাংলা। তখন সেখানে রবীন্দ্রসাহিত্য নিষিদ্ধ। ১৯৬৪-তেই সংগঠিত হয় নারকীয় এক গণহত্যা। হাজারে হাজারে বাঙ্গালী হিন্দুর লাশ পড়েছে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে। হিন্দুরা সকলেই তখন পথের ভিখারী। বাঙ্গালী হিন্দুকে অর্থনৈতিকভাবে উদ্বাস্তু করার পর এবার সাংস্কৃতিকভাবে ছিন্নমূল করার পালা। ১৯৬৬ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমিতে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ তার ৪ নং সুপারিশে সিদ্ধান্ত নিল আকবরই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।এই ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ই বাংলা পঞ্জিকাকে খানিক পরিবর্তন করে একটি নতুন পঞ্জিকা প্রস্তাব করল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় ক্যালেন্ডার। এখানেই ১৪ই এপ্রিলের দিনটিকে পয়লা বৈশাখকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, মাসের দিনগুলির সংখ্যা পাল্টে দেওয়া হয় ইত্যাদি। 
       

 তাহলে প্রশ্ন, এই বঙ্গাব্দের পথচলা কবে শুরু হয়েছিল? সহজ হিসেব বলে, এই বছর ১৪২৭ বঙ্গাব্দ যদি ২০২০ খ্রিস্টাব্দ হয়, তাহলে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর নিশ্চয় ২০২০ – ১৪২৬ অর্থাৎ ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামন্তরাজা শশাঙ্ক নিজেকে বঙ্গের স্বাধীন সার্বভৌম শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। মহারাজা শশাঙ্ক স্বাধীন নৃপতি হিসেবে তার শাসনকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক বর্ষপঞ্জী অনুসারে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। এই ব্যাপারে সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গাব্দের উৎস কথা‍’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, “সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গাণিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।‍” 
       বারোটি নক্ষত্রের নাম নিয়ে পরবর্তীকালে নামকরণ করা হয় বাংলা মাসের। বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভদ্রপদ থেকে ভাদ্র, আশ্বায়িনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, আগ্রায়হন থেকে অগ্রহায়ণ, পউস্যা থেকে পৌষ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র। 
       ঐতিহাসিকদের মতে, পহেলা বৈশাখ উৎসবটি ঐতিহ্যগত হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কিত যা Vaisakhi ও অন্য নামে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই দিনে এই উৎসব পালিত হয়। এই Vaisakhi-কে Baisakhi উচ্চারণও করা হয়।   
শিখ সম্প্রদায়ের মানুষও এই উৎসব পালন করে। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নববর্ষের উৎসবগুলো হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে সম্পর্কিত। এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে। ভারতের গ্রামীণ বাঙ্গালি সম্প্রদায়ে ভারতের অনেক অঞ্চল ও নেপালের মত বিক্রমাদিত্যকে বাংলা দিনপঞ্জির আবির্ভাবের স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু সেই অঞ্চলগুলোর মত বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি, বরং ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল, যা নির্দেশ করছে বঙ্গাব্দের সূচনা প্রমাণ সময়কে কোন একসময় পরিবর্তিত করা হয়েছে। মনে করা হয় শাশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়। 

          পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎচৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় গাজন উৎসব উপলক্ষ্যে চড়ক পূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসী বা ভক্তগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে আরাধ্য দেবতার সন্তোষ প্রদানের চেষ্টা এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন। এছাড়া, বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা । এই উপলক্ষ্যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে মঙ্গলদাত্রী লক্ষী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা করা হয়। নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিকা আঁকা হয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে বিভিন্ন মন্দির ও অন্যান্য প্রাঙ্গনে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মোলা । এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়। আগেকার সময় পয়লা বৈশাখের দিনে জমির মালিকরা নিজের অঞ্চলে মিষ্টি বিতরণ করতেন। পরে এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। গ্রাম বা শহরে পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হত। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে।
         ভারতীয় নববর্ষের মালায় বঙ্গাব্দ উজ্জল মুক্তো 
     ১লা বৈশাখ শুধু মনুষ্য সৃষ্ট নববর্ষ নয় এ সময় প্রকৃতিও সেজে উঠে নতুন রুপে। প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক নববর্ষ গুলির সূচনা হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে ১লা বৈশাখ পালিত হয় নববর্ষের অন্যতম অনুষ্ঠান হালখাতা, দেব দেবীর মন্দির দর্শন ইত্যাদি দিয়ে। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পশ্চিম দিনাজপুরের আদিবাসীরা নববর্ষ পালন করে ১লা মাঘ। অনুষ্ঠানের নাম 'মাগসিম'। ঐ দিন মাদলের শব্দে জেগে ওঠে সাঁওতাল পল্লির মানুষ। প্রত্যেকেই হাতে একটি মুরগি নিয়ে হাজির হয় বট বা অশ্বত্থ গাছের তলায়। আরাধ্য দেবতাকে নিবেদন করে মুরগিটিকে। অনেকে আবার কচিপাতা বা ফল ও নিবেদন করে। কৃষি কাজে যুক্ত যারা, তারা হাল, লাঙল ছুঁয়ে ফসল বোনার শপথ নেয়। মেয়েদের চুলের খোঁপায় থাকে রঙিন ফুল আর পাখির পালক।
   
 অসমে ১লা বৈশাখ পালিত হয় 'বিহু' নামে নববর্ষ। এটি অবশ্য পালিত হয় বছরে তিন বার। নতুন বছরে প্রথম দিনটিতে হয় রংগালি বিহু, কার্তিক মাসে হয় কাঙালি বিহু, আর মাঘে হয় ভোগালি বিহু।বিহু উত্‍‌সবে অসমের ঘরে ঘরে তৈরি হয় পিঠে, চলে পিঠে উত্সব। চাল, তিল, নারকেল দিয়ে তৈরী সেই পিঠের নাম 'খোলসাপুরি'। পিঠে খাওয়া আর নতুন জামাকাপড় পরে বাড়ি বাড়ি য়াওয়া আর সৌজন্য বিনিময় এই উত্‍‌সবের অঙ্গ। 
      অন্যদিকে মণিপুরে নববর্ষ উত্সব কিছুটা অন্যরকম। বৈষ্ণবধর্মী মণিপুরীরা সেদিন কোলাহল থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন বেশি। ১লা বৈশাখ নববর্ষ হলেও উত্‍‌সবের শুরুটা হয়ে যায় দোল উত্‍‌সবের মধ্য দিয়ে। নতুন বছরের প্রথম দিন পর্যন্ত চলে এই রঙের খেলা। বৈষ্ণবধর্মের মূলমন্ত্র পরধর্ম সহিষ্ণুতা, তাই স্ফূর্তির বাঁধন থেকে বেরিয়ে আত্মসংযমের সাহায্যেই মণিপুরীরা ১লা বৈশাখ পালন করে। 
        কর্নাটকের নববর্ষ যুগাদি পালিত হয় ১লা চৈত্র, আকাশের চাঁদ দেখে শুরু হয় যুগাদি।
      পাঞ্জাবীরা ১লা বৈশাখের আগের দিন নববর্ষ শুরু করেন, আসল উত্সব অবশ্য পরের দিন, ওঁরা একে বলেন বৈশাখী। পাঞ্জাবীরা গুরুগোবিন্দর স্মরণ করে গুরুদ্বারের সরোবরে স্নান করে 'গ্রন্থসাহেব' পাঠ করেন ১লা বৈশাখ সকাল থেকে, গুরুদ্বারগুলিতে চলে উপাসনা, দুপুরে চলে ভোজ। খাওয়া শেষ হলে সকলে একসঙ্গে দৌড়ে যান কৃষিক্ষেতের দিকে, সেখানে ভরা ফসলের দিকে তাকিয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুরু হয় প্রীতি ও সৌজন্য বিনিময়। পরের দিন থেকে শুরু হয় গম কাটার কাজ। 
     রাজস্থানে নববর্ষ পালিত হয় রাম নবমীর দিন। 

    গুজরাতে নববর্ষ হয় অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিন। তামিলনাডুতে নববর্ষ পালন করা হয় পয়লা এপ্রিল। চৈত্রপূর্নিমায় নববর্ষ পালন হয় অন্ধ্রপ্রদেশে, কেরলে বিশু নামে নববর্ষ পালন হয় ১৪ই এপ্রিল। কেরলের দক্ষিণ অংশে আরও একটা নববর্ষ পালন হয় ওনাম নামে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হয় এই ওনাম। তামিল ভাষায় নববর্ষ উত্‍‌সবের নাম 'পুটুবর্ষ পিরাপ্পু'। এপ্রিল মাসকে তারা বলে 'চিহিরাই' মাস। অন্ধ্রপ্রদেশে খুব ভোরে উঠে লোকেরা কৃষ্ণা, কাবেরী আর গোদাবরীর জলে স্নান করে নতুন কাপড় পরে বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে পূজো দেয়। সেদিন নিমফুল, আম, গুড়, আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে চাটনি বানায়, তার নাম 'উগাদি পার্য্চাদি'। চাটনির তেতো, মিষ্টি, টক, ঝাল বাস্তব জীবনে ঐ সব উপকরণের প্রতীক হিসেবে বছরের প্রথম দিন থেকেই গ্রহণ করা হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...