সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইউনিফর্ম সিভিল কোডের বিরোধিতা মূলত দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা,সার্বভৌমত্বে আঘাত

                                                                                        

       ইউনিফর্ম সিভিল কোডের বিরোধিতা মূলত দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা,সার্বভৌমত্বে আঘাত
                    
                            সাধন কুমার পাল


অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী?
 
এক কথায় বলতে গেলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হল সকলের জন্য এক আইন, যা সারা দেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও লাগু হবে। এর মধ্যে রয়েছে, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক প্রভৃতি। সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, ভারতের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে।Article 44 in Directive Principles of State Policy states that “The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India” 

 সিএএ, ৩৭০ ধারা অথবা কৃষি বিল নিয়ে দেশের অপপ্রচার গ্যাং যে ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে ছিল ঠিক একই রকম ভাবে এই গ্যং uniform civil code নিয়ে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন কাল্পনিক, অযৌক্তিক যুক্তি তৈরী করে আবার বিভ্রান্তিকর উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরী করার প্রয়াস হচ্ছে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে অপপ্রচার

মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’::এক শ্রেণির মানুষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইস্যুটিকে মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত বলে অভিহিত করে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেছেমানুষ ক্ষেপিয়ে দেওয়ার জন্য অপপ্রচার চালিয়ে বলা হচ্ছে যে এই আইন চালু হলে মুসলমানরা তাদের মৃতদের কবর দিতে পারবে না এবং তার পরিবর্তে দাহ করতে হবে , তাদের বিয়ের সময় হিন্দু রীতি মেনে চলতে হবে, মাথার খুলির টুপি পরতে পারবে না এবং তাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে শুধুমাত্র বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার এবং উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমতার বিধানের কথা বলা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশের (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, লিঙ্গায়ত), অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি অনেক উপজাতীয় সমাজেও প্রযোজ্য হবে।

ফৌজদারি আইন সবার জন্য এক হলেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ভয় কেন ?:: ভারতীয় চুক্তি আইন, দেওয়ানী কার্যবিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, অংশীদারি আইন ইত্যাদির মতো আইনের মাধ্যমে অধিকাংশ নাগরিক বিষয়েই একটি অভিন্ন বিধি রয়েছে ভারতে। এখানে চিন্তা করার বিষয় হল যে ফৌজদারি আইন সহ আরো কিছু আইন , যা সমস্ত ভারতীয়দের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, যা একজন মুসলমানের বিশ্বাস ও আস্থাকে প্রভাবিত করে না, সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করা হলে ইসলাম সহ যে কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস কীভাবে বিপন্ন হতে পারে?

ইসলামী শরিয়া আইন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি: প্রায়শই আরেকটি যুক্তি দেওয়া যে মুসলমানদের শরিয়া আইনে সংস্কারের কোন সুযোগ নেই এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে, তাদের পারিবারিক আইন শুধুমাত্র শরিয়ার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। ইতিহাস বলছে ইসলামী পন্ডিতদের দ্বারা সময়ে সময়ে ইসলামী শরিয়া আইন গঠিত এবং সংশোধন করা হয়েছে।যেমন খলিফা উমরের শাসন মলে, যখন প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তিনি শরিয়া আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটার বিধান স্থগিত করেন। উল্লেখ্য যে, এই শাস্তির কথা কুরআনেও উল্লেখ আছে। তারপরও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সমন্বয় করা হয়েছে। শরিয়া আইন শুধুমাত্র দেওয়ানী বিষয় নয় বরং দণ্ডবিধিকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা এবং ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুড়ে হত্যার মতো গুরুতর শাস্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাকিস্তান, তিউনিসিয়া এবং তুরস্ক সহ মুসলিম রাজ্যে বসবাসকারী অনেক মুসলমান শরিয়া আইন মেনে চলে না। ইতিমধ্যে অমুসলিম রাজ্যে বসবাসরত মুসলমানরা দেওয়ানি ও দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রের আইন মেনে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহনাগরিকদের মতো ফৌজদারি বিষয়ে শরিয়া আইন অনুসরণ করেনি এবং পরিবর্তে ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি) অনুসরণ করেছে ।

সাংস্কৃতিক আক্রমনের ভীতি:: অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করে মুসলিম, খ্রীষ্টান সহ সবাইকে বলপূর্বক হিন্দু রীতিনীতিতে নিয়ে আসার চক্রান্ত হচ্ছে এমন অপপ্রচার চালিয়ে ভয়ের পরিবেশ নির্মানের প্রয়াস হচ্ছে। এই সমস্ত অপপ্রচারের পিছনে আসলে কোন যুক্তি নেই । এই ধরনের অপপ্রচার কারীরা এই আইনে এমন একটি শব্দও দেখাতে পারবে না য়ার দ্বারা প্রমাণ হয় যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস বা রীতিনীতিতে কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে।বৌদ্ধ, জৈন, পার্শীরা এতদিন হিন্দু কোড বিলের আওতায় ছিলেন ।আজ পর্যন্ত কেউ এমন একটি প্রমান দিতে পারবে যে হিন্দু কোড বিলের জন্য এই সম্প্রদায় গুলিকে তাদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে হয়েছে বা রীতি নীতিতে কোন রকম আঁচ পড়েছে।

বামেরা এক সময় পক্ষে কিন্তু এখন বিপক্ষে:: জনসঙ্ঘের সময় থেকে বিজেপি ৩৭০ ধারা, বামমন্দিরের সাথে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাগু করার বিষয়টি তাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গুলির মধ্যে স্থান দিয়ে এসেছে। বিজেপির এই আদর্শ গত অবস্থান সংবিধান প্রনেতাদের ইচ্ছের সাথে মিলে যায় । কিন্তু অন্যান্য সমাজবাদী দল ও বামেদের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। নয়ের দশক পর্যন্ত বামপন্থীরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জোরদার সওয়াল করতো। কিন্তু এখন ওরা অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাগু করার বিপক্ষে কথা বলছে। ১৯৮৬ সালে শাহবানু মামলায় কেন্দ্রের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে অভিন্ন দেওয়ানী বিধির পক্ষে সওয়াল করে আরিফ মোহম্মদ খান (বর্তমানে কেরলের রাজ্য পাল) রাজীব গান্ধী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে ছিলেন।সে সময় বাপন্থী সহ বিভিন্ন সমাজবাদী দল আরিফ মোহম্মদ খানের এই অবস্থান কে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন।

       অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বিরোধিতা মূলত দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা, যা অতীতে ভারতের উন্নয়নে বাধা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি কে দেশের জন্য একটি যথাযথ দেওয়ানি বিধি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ইসলামিক পন্ডিতদের অনেকেই বলছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানী বিধি আরও ভাল নাগরিক আইন। সংবিধান বিশেজ্ঞরাও বলছেন UCC(Uniform Civil Code) is part of Part IV of the Constitution which includes the Directive Principles of State Policy (DPSP). Article 44 in DPSP states that “The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India”. বেশ কয়েকবার, এই জাতীয় আইনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার সময়, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে এর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, তবে সেগুলি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেরীতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছে। সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বৃত্তের বাইরে এসে এই আইন কে সমর্থন করলে দিকে দিকে আওয়াজ উঠবে এক দেশ, এক আইন, এক লক্ষ্য যা ভারতীয় সভ্যতার যে মূল মন্ত্র “বসুধইব কুটুম্বকম”এর ফলিত রুপকে সাকার করে তুলবে। গড়ে উঠবে শক্তিশালী ভারত।## 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...