![]()  | 
| সাধন কুমার পাল | 
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (ইউনিফর্ম সিভিল কোড) মানে ধর্ম, বর্ণ বা জাতি নির্বিশেষে ভারতে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি অভিন্ন আইন। অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের জন্য একই আইন। সিভিল কোড কার্যকর হলে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সস্তান দত্তক এবং সম্পত্তি ভাগের মতো বিষয়ে সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন নিয়ম থাকবে। এর লক্ষ্য বর্তমানে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন পারিবারিক আইন প্রতিস্থাপন করা যা ধর্মীয় ও লিঙ্গ পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়।
ভারতে পারিবারিক আইনের (পার্সোনাল ল) পার্থক্যের একটি উদাহরণ :
বর্তমানে ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে মহিলাদের অধিকার, উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আলাদা আলাদা আইন রয়েছে। ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের অধীনে, (যা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে) হিন্দু নারীদের তাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে হিন্দু পুরুষদের মতোই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের সমান অধিকার রয়েছে। বিবাহিত ও অবিবাহিত কন্যাদের অধিকার সমান এবং পৈতৃক সম্পত্তি ভাগের জন্য নারীরা যৌথ আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃত। মুসলমান ব্যক্তিগত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মুসলমান মহিলারা তাদের স্বামীর সম্পত্তির একটি অংশ পাওয়ার অধিকারী যা সস্তানের সংখ্যার উপর নির্ভর করে হয় ১/৮ বা ১/৪ অংশ। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশ অর্ধেক। খ্রিস্টান, পার্সি ও ইহুদিদের জন্য ১৯২৫ সালের ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন প্রযোজ্য। খ্রিস্টান মহিলারা শিশু বা অন্যান্য আত্মীয়দের উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে একটি পূর্বনির্ধারিত অংশ পান। পার্সি বিধবারা তাদের সন্তানের সমান পায়, সন্তানের অর্ধেক অংশ মৃতের বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদের কাছে যায়।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে যুক্তি :
(১) দেশে অভিন্ন ফৌজদারি বিধি চালু । থাকলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে কেন আপত্তি, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে দেশ জুড়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় পঞ্চাশের দশকে হিন্দু কোড বিলের আমূল সংস্কার করা হয়েছে।
(২) স্বাধীনতার পরেই অভিন্ন দেওয়ানি | বিধি চালু নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে সংবিধান সভায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু সভায় শেষ পর্যন্ত ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদটি গৃহীত হয়, তবে বিধির প্রণয়ন ও প্রয়োগের দায়িত্ব ভবিষ্যতের সংসদ ও সরকারের উপরে ন্যস্ত হয়। Article 44 in Directive Principles of State Policy States that The State shall endeav- our to secure for the citizens a uni- form civil code throughout the terri- tory of india' স্বাভাবিকভাবেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রণয়ন একটি সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি, যা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও পালিত হয়নি।
(৩) ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এখন প্রায় ১৫টি পারিবারিক আইন চালু রয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় ভারতে বর্ণ ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন আইন এবং বিবাহ আইন রয়েছে। এ কারণে সামাজিক কাঠামোর অবনতি ঘটেছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর হলে সেগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এই কারণেই দেশে একটি অভিন্ন সিভিল কোডের দাবি উঠেছে যা সমস্ত জাতি, ধর্ম, শ্রেণী ও সম্প্রদায়কে এক ব্যবস্থার আওতায় আনবে। একটি কারণ বিভিন্ন আইনের কারণে বিচার ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে লোকেরা বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি বিষয়গুলির নিষ্পত্তির জন্য ব্যক্তিগত আইন বোর্ডের কাছে যায়। এর সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি হলো ড. আম্বেদকর দ্বারা কল্পনা করা সমাজের দুর্বল অংশগুলিকে নিরাপত্তা প্রদান করা, যার মধ্যে নারী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রয়েছে, সেইসঙ্গে ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে মজবুত করা।
(৪) ভারতীয় সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। একাধিক মামলায় সুপ্রিম কোর্টও বিধি চালু করার কথা ভাবতো বলেছে কেন্দ্রকে। কিন্তু কোনও স্পষ্ট নির্দেশ দেয়নি।
(৫) শাহবানো মামলায়, আদালতের পর্যবেক্ষণ হলো যে ধারা ৪৪ একটি “মৃত চিঠি" ('dead letter')-তে পরিণত হয়েছে এবং আদালতের আরও সংযোজন একটি অভিন্ন দেওয়ানি আইন 'বিরোধপূর্ণ মতাদর্শ রয়েছে এমন আইনের প্রতি আনুগত্য দূর করে জাতীয় সংহতির কারণকে সাহায্য করবে। এতে বলা হয়েছে যে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন নাগরিক বিধি সুরক্ষিত করার দায়িত্ব আইনসভার উপর অর্পিত।
(৬) ১৯৯৫ সালে সরলা মুদগল মামলায় । সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে অনুচ্ছেদ ৪৪ পুনরায় পরীক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছিল যার লক্ষ্য সমগ্র ভারতে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রতিষ্ঠা করা।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে অপপ্রচার
এক শ্রেণীর মানুষ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইস্যুটিকে মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে 'হস্তক্ষেপ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত বলে অভিহিত করে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেছে। মানু ক্ষেপিয়ে দেওয়ার জন্য অপপ্রচার চালিয়ে বলা হচ্ছে যে এই আইন চালু হলে মুসলমানরা তাদের মৃতদের কবর দিতে পারবে না এবং তার পরিবর্তে দাহ করতে হবে, তাদের বিয়ের সময় হিন্দু রীতি মেনে চলতে হবে, মাধ্যায় ফেজ টুপি পরতে পারবে না এবং তাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে শুধুমাত্র বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেন, ভরণপোষণ এবং উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমতার বিধানের কথাই বলা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশের (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, লিঙ্গায়েত), অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি অনেক উপজাতি সমাজেও প্রযোজ্য হবে।
ফৌজদারি আইন সবার জন্য এক হলেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে ভয় কেন? :
এখানে চিন্তা করার বিষয় হলো যে ফৌজদারি আইন, যা সমস্ত ভারতীয়দের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং একজন মুসলমানের বিশ্বাস ও আস্থাকে প্রভাবিত করে না, সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করা হলে ইসলাম-সহ যে কোনো সম্প্রদায়ের বিশ্বাস কীভাবে বিপন্ন হতে পারে।
ইসলামি শরিয়া আইন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি;
প্রায়শই আরেকটি যুক্তি দেওয়া হয় যে মুসলমানদের শরিয়া আইনে সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে, তাদের পারিবারিক আইন শুধুমাত্র শরিয়ার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। ইতিহাস বলছে বিভিন্ন দেশে সময়ে সময়ে ইসলামি শরিয়া আইনে সংশোধন করা হয়েছে। যেমন খলিফা উমরের শাসন আমলে, যখন প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তিনি শরিয়া আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কেটে ফেলার বিধান স্থগিত করেন। উল্লেখ্য যে, এই শাস্তির কথা কোরানেও উল্লেখ আছে। তারপরও জনগণের বৃহত্ত স্বার্থে সমন্বয় করা হয়েছে। শরিয়া আইন শুধুমাত্র দেওয়ানি বিষয় নয় বরং দণ্ডবিধিকেও অন্তর্ভুক্ত করে, যার মধ্যে চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা এবং ব্যভিচারের জন্য পাথর খুঁড়ে হত্যার মতো গুরুতর শাস্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, তুরস্ক-সহ ইসলামি রাজ্যে বসবাসকারী অনেক মুসলমান শরিয়া আইন মেনে চলেন না। ইতিমধ্যে অমুসলমান রাজ্যে বসবাসরত মুসলমানরা দেওয়ানি ও দণ্ডবিধিতে দেশের আইন মেনে আসছে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সহ-নাগরিকদের মতো ফৌজদারি বিষয়ে শরিয়া আইন অনুসরণ করেনি এবং পরিবর্তে ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি) অনুসরণ করেছে।
সাংস্কৃতিক আক্রমণের ভীতি :
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রয়োগ করে মুসলমান, খ্রিস্টান-সহ সবাইকে বলপূর্বক হিন্দু রীতিনীতিতে নিয়ে আসার চক্রান্ত হচ্ছে এমন অপপ্রচার চালিয়ে ভয়ের পরিবেশ নির্মাণের প্রয়াস হচ্ছে। এই সমস্ত অপপ্রচারের পিছনে আসলে কোনো যুক্তি নেই। এই ধরনের অপপ্রচারকারীরা এই আইনে এমন একটি শব্দও দেখাতে পারবে না যার দ্বারা প্রমাণ হয় যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কোনো সম্প্রদায়ের বিশ্বাস বা রীতিনীতিতে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে। বৌদ্ধ, জৈন, পাশীরা এতদিন হিন্দু কোড বিলের আওতায় ছিলেন। আজ পর্যন্ত কেউ এমন একটি প্রমাণ দিতে পারবে যে হিন্দু কোড বিলের জন্য এই সম্প্রদায়গুলিকে তাদের নিজের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে হয়েছে বা রীতিনীতিতে কোনো রকম আঁচ পড়েছে।
বামেরা এক সময় পক্ষে ছিল কিন্তু এখন বিপক্ষে:
জনসঙ্ঘের সময় থেকে বিজেপি ৩৭০ ধারা, রামমন্দিরের সঙ্গে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার বিষয়টি তাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলির মধ্যে স্থান দিয়ে এসেছে। বিজেপির এই আদর্শগত অবস্থান সংবিধান প্রণেতাদের মানসিকতার সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু অন্যান্য সমাজবাদী দল ও বামেদের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বামপন্থীরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জোরদার সওয়াল করতো। কিন্তু এখন ওরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার বিপক্ষে কথা বলছে। ১৯৮৬ সালে শাহবানু মামলায় কেন্দ্রের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে জোরদার সওয়াল করে আরিফ মহম্মদ খান (বর্তমানে কেরালার রাজ্যপাল) রাজীব গান্ধী মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সে সময় বামপন্থী-সহ বিভিন্ন সমাজবাদী দল আরিফ মহম্মদ খানের এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা মূলত দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধিতা, যা অতীতে ভারতের উন্নয়নে বাধা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সুতরাং অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে দেশের জন্য একটি যথাযথ দেওয়ানি বিধি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ইসলামি বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আরও ভালো নাগরিক আইন। সংবিধান বিশেজ্ঞরাও বলছেন UCC (Uniform Civil Code) is part of Part-IV of the Constitution which includes the Directive Principles of State Policy (DPSP). Article 44 in DPSP state that 'The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India'.
বেশ কয়েকবার, এই জাতীয় আইনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার সময়, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে এর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু সেগুলি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেরিতে হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এই আইন বাস্তবায়নের কাজে হাত দিয়েছে। সংকীর্ণ রাজনীতির বৃত্তের বাইরে এসে এই আইনকে সমর্থন করলে দিকে দিকে আওয়াজ উঠবে এক দেশ, এক আইন, এক লক্ষ্য যা ভারতীয় সভ্যতার যে মূল মগ্ন 'বসুধৈব কুটুম্বকম্'-এর ফলিত রূপকে সাকার করে তুলবে।##
##আপনার মূল্যবান মন্তব্য ও মতামত এই ব্লগের কমেন্ট বিভাগে নথি ভুক্ত করুণ ##
😀😀😀 আত্মঘাতি বাঙালির বিস্মৃতির অতলে ২০ জুন,পশ্চিমবঙ্গ দিবস😀😀😀
❤❤ পড়তে হলে ক্লিক করুণ:: নতুন সংসদ ভবন ত্রিভুজাকৃতি, ষড়ভুজাকৃতি কেন?❤❤

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন