সংসদে মেঘনাদ সাহার ভাষণ
(১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩)
শ্রী মেঘনাদ সাহা: বন্দীদশায় শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর পূর্ণ তদন্তের জন্য যে দাবী আমার মাননীয় বন্ধু শ্রীযুক্ত এন সি চ্যাটার্জি উপস্থাপিত করেছেন, আমি সর্বান্তঃকরণে সেই দাবীকে সমর্থন করছি। আমি দুই তরফের যুক্তি তর্ক শুনেছি। আমি এই দেখে খুবই মর্মাহত হলাম যে, আমার বিপরিত দিকে যে বন্ধুরা বসে রয়েছেন তাঁরা এই তদন্তের অত্যন্ত সরল ও সহজ দাবীর বিরোধিতা করেছেন। আমি আরও দুঃখিত হলাম এই দেখে যে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু সম্বন্ধে সহস্র সহস্র কংগ্রেস সদস্যকে ব্যক্তিগত আলাপে যে অভিমত ব্যক্ত করতে শুনেছি, সে সম্বন্ধে সংসদে দাঁড়িয়ে উঠে তাঁদের কেউই কিছু খুলে বল্লেন না, মতামত প্রকাশ করার সব দায়িত্ব অর্পণ করলেন গৃহমন্ত্রী ডঃ কাটজুর উপর।
ডঃ মুখার্জি যে শহর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, আমি সেই কলকাতা শহর থেকে আসছি। ডঃ মুখার্জি কলকাতায় জন্মেছিলেন ও সেখানেই প্রতিপালিত হয়েছিলেন। কলকাতার প্রত্যেকেই তাঁকে ভাল করে চিনতেন এবং গত মাসে আমি যখন কলকাতায় ছিলাম তখন শতশত লোক আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলেন যে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ও মুক্ত তদন্ত যেন অবিলম্বে করানো হয়। আমি জানি না কেন ডঃ কাটজু তাঁর যাবতীয় আইন-সংক্রান্ত জ্ঞান প্রয়োগ করে তদন্তের এই সামান্য দাবীর বিরোধিতা করেছেন। ডঃ কাটজুকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি কিন্তু তৎসত্ত্বেও দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি তদন্তের বিরোধিতা করে তিনি যে-সব আইন-সংক্রান্ত যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছেন তা আমাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে নি। এটা একটা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর ধারণা, যে ধারণা সত্য না ভ্রান্ত তা আমার জানা নেই, যে, শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যু ঘটেছে সন্দেহজনক পরিবেশের মধ্যে। এখানে আমরা শ্রীযুক্ত চাটার্জির বক্তব্য শুনেছি, যে বক্তব্যের বিরোধিতা করে ডঃ কাটজু যা বলেছেন তা শুনেছি এবং অন্য সকলের যুক্তি-তর্কও শুনেছি। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর তদন্ত অতি সহজেই করানো যেত, জনসাধারণের সমক্ষে সেই ঘটনাবলী সংক্রান্ত সব তথ্য পেশ করা যেত অনায়াসেই। আমার মনে হয় যে সরকার যদি তদন্তের এই দাবী মেনে নিতেন তাহলে জনসমক্ষে সরকারের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল হত। কিন্তু সরকার যে পথে গেলেন না। আমি খুবই বিস্মিত হলাম যখন ডঃ কাটজু শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর জন্য আমার মাননীয় বন্ধু শ্রীযুক্ত ত্রিবেদীকে দায়ী করলেন। শ্রীযুক্ত ত্রিবেদী চিকিৎসক নন, আর এটা সবাই জানে যে, কেউ গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার বন্ধুরা তার শয্যাপার্শ্বে এসে সমবেত হয় তাকে সান্ত্বনা দিতে ও নিজেদের কৌতূহল চরিতার্থ করতে। ডঃ কাটজু বলেছেন যে শ্যামাপ্রসাদের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত থেকে শ্রীযুক্ত ত্রিবেদী তাঁর মৃতুকে ত্বরান্বিত করেছেন। এটা একটা অদ্ভুত যুক্তি।
শ্রী ইউ এস. ত্রিবেদী :অত্যন্ত হাস্যকর।
শ্রী মেঘনাদ সাহা: এ জগতের কেউই এই ধরণের যুক্তি মেনে নেবে না-এটা অতি উদ্ভট ও কুরুচিপূর্ণ যুক্তি-
শ্রীমতী সুচেতা কৃপালনী: অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ।
শ্রী মেঘনাদ সাহা:... শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর দায়িত্ব এভাবে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর উপর। এই ধরণের যুক্তি কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে না।
ডঃ মুখার্জি অতি বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর বাল্যাবস্থা থেকে আমি তাঁকে চিনতাম। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। বস্তুতঃ উনি যখন ঘোষণা করলেন যে উনি কাশ্মীর যাচ্ছেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে, তাঁর কাশ্মীরে যাওয়া ঠিক হবে না। এ ব্যাপারের আইন-গত দিক সম্বন্ধে আমার সম্যক্ পরিচিতি ছিল না। যে উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য উনি কাশ্মীরে যাওয়া মনঃস্থ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্যের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল না। আমি তাঁকে গিয়ে সোজাসুজি বল্লাম "আপনি নিজেকে আপনার শত্রুপক্ষের খপ্পড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলছেন- কোন বুদ্ধিমান লোকই নিজেকে তার শত্রুর আওতায় নিক্ষেপ করে না।" তিনি বল্লেন যে, তিনি কাশ্মীরে বন্দী হতে যাচ্ছেন না। তিনি বল্লেন "ভারত সরকার আমাকে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে দেবে না। আমাকে ভারতেই বন্দী করে রাখবে।" তিনি কখনও ভাবতেই পারেন নি যে, ভারত সরকার তাঁকে কাশ্মীরে ঢুকতে দেবে।
আমার মনে হয় যে, শ্রীযুক্ত চ্যাটার্জি আইন-সংক্রান্ত দিকগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। আমি তাই সে বিষয়ে কিছু বলব না। আমার ধারণা ডঃ মুখার্জি খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন যখন ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা তাঁকে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে রীতিমত সহায়তা করল, কোনওরকম বাধা না দিয়ে। আমার মনে হয় এ সব ঘটনার পেছনে একটি উচ্চস্তরের মাথা কাজ করছিল-আর সেই মাথাটি কার তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
সে যাই হোক, আমি দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে সংসদকে বিব্রত করতে চাই না। আমি মনে করি যে দেশেরও লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর দাবী হচ্ছে যে শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুকালীন ঘটনাবলীর পূর্ণাঙ্গ ও মুক্ত তদন্ত হোক ও আমি অপর পক্ষ অর্থাৎ সরকার পক্ষকে শ্রীযুক্ত চ্যাটার্জির আনা এই তদন্ত সংক্রান্ত প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি যাতে সব সন্দেহের নিরসন হয়; যা এখন লক্ষ লক্ষ মানুষের মনকে ভারত সরকার ও কাশ্মীর সরকারের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তুলেছে।
(সূত্র: শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত Meghnad Saha in Parliament। প্রকাশক: এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা-১৯)

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন