✨ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার : দুই মহাপুরুষের একই লক্ষ্য
ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মধারা ভিন্ন সময়ে হলেও তাঁদের মূল লক্ষ্য এক ছিল—জাতিকে ভিতর থেকে শক্তিশালী করে দেশের মুক্তির ভিত্তি গড়ে তোলা।
🌿 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাজ (১৯শ শতক)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার অন্যতম সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাবিদ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে, তখন বিদ্যাসাগর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে। কংগ্রেস তাঁকে সদস্য বা সমর্থক করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তিনি কংগ্রেসে যোগ দেননি।
✋ কেন বিদ্যাসাগর কংগ্রেসে যোগ দেননি?
বিদ্যাসাগর মূলত সমাজসংস্কারক ছিলেন, সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছিলেন না। কংগ্রেস সম্পর্কে তিনি কয়েকটি আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন—
• কংগ্রেস মধ্যবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকদের সংগঠন –
বিদ্যাসাগরের মতে, গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিকদের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো সংযোগ ছিল না। ফলে এটি প্রকৃতপক্ষে "জনতার দল" নয়, বরং শহুরে শিক্ষিত সমাজের একটি মঞ্চ।
• বাস্তব সমস্যার সমাধান নয়, কেবল বক্তৃতা –
তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেসের অধিবেশনে বড় বড় বক্তৃতা হয়, রেজোলিউশন পাস হয়, কিন্তু দেশের দরিদ্র মানুষ, নারী, বিধবা বা অসহায়দের জীবনে তার কোনো বাস্তব প্রভাব পড়ে না।
• বিদেশি শাসনের অধীনে সীমিত দাবি –
বিদ্যাসাগর মনে করতেন, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থেকে কংগ্রেস যে দাবি জানাচ্ছে তা কেবল প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এতে প্রকৃত স্বাধীনতা বা শোষিত মানুষের মুক্তি আসবে না।
🏛️ বিদ্যাসাগরের আসল উদ্বেগ
• তিনি সারাজীবন লড়াই করেছেন বিধবা বিবাহ, নারীশিক্ষা, শিশুশিক্ষা, ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য।
• তাঁর মতে, ভারতবাসী প্রথমে শিক্ষিত ও সামাজিকভাবে সংস্কৃত হতে হবে।
• তিনি বলেছিলেন,
"অশিক্ষিত, অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন জনগণকে নিয়ে কেবল রাজনীতি করে লাভ নেই। আগে সমাজের ভিত্তি শক্ত করতে হবে।"
📌 সংক্ষেপে
• বিদ্যাসাগর কংগ্রেসে যোগ দেননি।
• তিনি বলেছিলেন কংগ্রেস জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন, কেবল ভদ্রলোকদের মঞ্চ।
• তাঁর মতে, সমাজসংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, নারী-পুরুষ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা—এসব কাজই ছিল জাতির প্রকৃত মুক্তির প্রথম ধাপ।
• তাই তিনি রাজনীতির পরিবর্তে সমাজ সংস্কারকে গুরুত্ব দিলেন।
• বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ স্বাধীন হতে পারে না।
• তাই তিনি সমাজের ভিত মজবুত করতে কাজ করলেন—
• নারীশিক্ষা বিস্তার: মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন, নারীশিক্ষার বিরোধিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
• বিধবা বিবাহ প্রচলন: সমাজের প্রতিকূলতার মধ্যেও আইনের মাধ্যমে বিধবা বিবাহ বৈধ করলেন।
• প্রাথমিক শিক্ষা: বাংলায় সহজপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ালেন।
• বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, আগে মানুষকে শিক্ষিত, যুক্তিবাদী ও সামাজিকভাবে মুক্ত করতে হবে, তবেই রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব।
🚩 ড. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের কাজ (২০শ শতক)
⚖️ প্রথম কারাবাস (১৯২১–১৯২২) – অসহযোগ আন্দোলন
• ডা:হেডগেওয়ার সে সময় নাগপুরে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত।
• গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ডাককে সমর্থন করে তিনি জনসভায় ব্রিটিশ বিরোধী ভাষণ দেন।
• তাঁর ভাষণ ছিল তীব্র, সরাসরি ইংরেজ শাসন উৎখাতের আহ্বান।
• তিনি ১৯২১ সালের আগস্ট মাসে গ্রেপ্তার হন এবং ১৯২২ সালের জুলাই মাসে মুক্তি পান, অর্থাৎ প্রায় ১১ মাস তিনি জেলে ছিলেন।
⚖️ দ্বিতীয় কারাবাস (১৯৩০–১৯৩১) – জঙ্গল সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ
প্রেক্ষাপট
• ১৯২৫ সালে
• ডা: হেডগেওয়ার আর.এস.এস. প্রতিষ্ঠা করেন।
• ১৯৩০ সালে জঙ্গল সত্যাগ্রহ শুরু হয়।
• তখন ডা: হেডগেওয়ার আর.এস.এস.-এর সরসংঘচালক (Sarsanghchalak)।
সিদ্ধান্ত
• ডা: হেডগেওয়ার মনে করতেন, আর.এস.এস.-কে সরাসরি কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যুক্ত করলে সংগঠন দুর্বল হতে পারে।
• তাই তিনি সংঘকে আলাদা রেখে নিজে ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
• তিনি নাগপুরে সংঘের দায়িত্ব শ্রী বাবাসাহেব আপটে ও বাপুরাও ভেদীর উপর অর্পন করেন । ডাক্তার পরাঞ্জপেকে সরসঙ্ঘচালক নিযুক্ত করা হয়।
কারাবাস
• পুলিশের চোখে তিনি ছিলেন আগেই নজরদারির মধ্যে।
• ফলস্বরূপ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কোন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
• তিনি ১৯৩০ সালের জুলাই থেকে ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে ছিলেন।
গুরুত্ব
• ডা: হেডগেওয়ারের দ্বিতীয় কারাবাস দেখিয়ে দেয় যে তিনি শুধু সংগঠন গড়তে নয়, প্রয়োজনে নিজেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের আগুনে নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করেননি।
• ডা: হেডগেওয়ার বুঝেছিলেন, শুধু রাজনৈতিক আন্দোলন দিয়ে স্বাধীনতা আসবে না, যদি সমাজ ভেতর থেকে দুর্বল থাকে।
• তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (১৯২৫), যার উদ্দেশ্য ছিল—
• যুবসমাজের চরিত্রগঠন: শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম ও আত্মনিয়োগ।
• সংগঠিত শক্তি তৈরি: ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিন্দু সমাজকে এক সূত্রে বাঁধা।
• সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ: দেশের ইতিহাস, ধর্ম ও ঐতিহ্যের গৌরব জাগ্রত করা।
• তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি যুবসমাজের মধ্যে শক্তি, সাহস ও ঐক্য জন্মায়, তবে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা সহজ হবে।
🔗 মিল কোথায়?
• ভিত্তি গঠন:
• বিদ্যাসাগর → শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ভিত গড়ে তুললেন।
• ডা: হেডগেওয়ার → সংগঠন ও চরিত্রগঠনের ভিত গড়ে তুললেন।
• রাজনীতির আগে সমাজ:
• বিদ্যাসাগর মনে করতেন অশিক্ষিত সমাজে রাজনীতি বৃথা।
• হেডগেওয়ারও বুঝেছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি জাতি–গঠনের প্রয়োজন।
• দেশপ্রেমের বীজ বপন:
• বিদ্যাসাগর তাঁর শিক্ষা ও সংস্কারের মাধ্যমে মানুষকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করলেন।
• হেডগেওয়ার যুবকদের মধ্যে দেশপ্রেম ও আত্মশক্তির জাগরণ ঘটালেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ডা: কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ভিন্ন শতকের মানুষ, কিন্তু তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একই—
“দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন জনগণ শিক্ষিত, সংগঠিত ও চরিত্রবান হবে।”
তাঁদের অবদান তাই একই সূত্রে বাঁধা—
• বিদ্যাসাগর ছিলেন সামাজিক মুক্তির স্থপতি,
• হেডগেওয়ার ছিলেন জাতি–সংগঠনের স্থপতি।
দু’জনের কাজই ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অদৃশ্য কিন্তু অটল ভিত্তি।##

খুব সুন্দর ও বিঞ্জানসম্মত বিশ্লেষণ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুন