লিখেছেন --সাধন কুমার পাল
শাস্ত্র ছাড়া শস্ত্র নয়, শস্ত্র ছাড়া শান্তি নয়”
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার শেষ শ্লোকে সঞ্জয় বলেন---
“यत्र योगेश्वरः कृष्णो यत्र पार्थो धनुर्धरः।
तत्र श्रीर्विजयो भूतिर्ध्रुवा नीतिर्मतिर्मम।।
অর্থাৎ যেখানে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ, যেখানে ধনুর্ধর অর্জুন—সেখানেই সমৃদ্ধি, বিজয়, কল্যাণ এবং দৃঢ় নীতি প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
এই শ্লোকের গভীরে এক অমোঘ সত্য লুকিয়ে আছে— সুখ-সমৃদ্ধির জন্য যেমন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, উদ্যম অপরিহার্য, তেমনি দুষ্টদমন ও শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজন শক্তি, প্রয়োজন অস্ত্র।
অর্থাৎ, শাস্ত্র (জ্ঞান) এবং শস্ত্র (শক্তি)-র সমন্বয়ই হলো পূর্ণাঙ্গ সমাজব্যবস্থার ভিত্তি।
শস্ত্রের ব্যবহার শান্তি বিনষ্টের জন্য নয়, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য—এই শিক্ষাই গীতার সার।
ইসরায়েল : আধুনিক কালে শাস্ত্র ও শস্ত্রের সার্থক রূপ
ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পরে বহু ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সরে গেছে। কিন্তু ছোট্ট দেশ ইসরায়েল জন্মলগ্ন থেকেই শাস্ত্র ও শস্ত্রের এই ভারসাম্যকে রাষ্ট্রনীতির ভিত্তি করেছে।
১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন সেখানে ছিল না পর্যাপ্ত জল, ছিল না উর্বর ভূমি। কিন্তু আজ মরুভূমিকে সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সবুজ করেছে তারা। কৃষি থেকে হাই-টেক অর্থনীতি—ইসরায়েলের এই রূপান্তর বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে।
হামাসের আক্রমণ ও আত্মরক্ষার শিক্ষা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে নৃশংস হামলা চালায়। নিরপরাধ নাগরিকদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল সেই রাত। কিন্তু আত্মরক্ষার নীতিতে ইসরায়েলের প্রত্যাঘাত প্রমাণ করে—
জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হলেও, শক্তিশালী সেনাশক্তি ছাড়া কোনও রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না।
সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে—
“अग्रतः चतुरो वेदाः पृष्ठतः सशरं धनुः।
इदं ब्राह्मं इदं क्षात्रं शापादपि शरादपि।।
অর্থাৎ সামনে থাকবে চার বেদ (জ্ঞান), আর পিছনে থাকবে ধনুক-বাণ (শক্তি)। জ্ঞান এবং বীর্য দুটোই অপরিহার্য।
অহিংসার প্রকৃত ব্যাখ্যা
প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
“অহিংসা পরমো ধর্মঃ, ধর্মহিংসা তথৈব চ।”
অর্থাৎ অহিংসা অবশ্যই পরম ধর্ম, কিন্তু ধর্মরক্ষার জন্য হিংসাই সর্বোত্তম ধর্ম।
অযথা হিংসা নিষিদ্ধ, কিন্তু জাতি, দেশ ও ধর্মকে রক্ষার জন্য হিংসা অপরিহার্য।
আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকেই শ্লোকের অর্ধেক তুলে ধরে সমাজকে বিভ্রান্ত করেছেন। কেবল “অহিংসা পরম ধর্ম” লিখে রাখলেই ধর্ম পালিত হয় না। কারণ ধর্মকে রক্ষা করার জন্য, আততায়ীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়াই প্রকৃত ধর্ম।
আততায়ী বধ : শাস্ত্রের নির্দেশ
বশিষ্ঠ স্মৃতিতে বলা হয়েছে ছয় ধরনের অপরাধী আততায়ী—
১. যে ঘরে আগুন দেয়
২. যে বিষ প্রয়োগ করে
৩. যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত
৪. যে ধনসম্পদ লুট করে
৫. যে ক্ষেত-খামার দখল করে
৬. যে গৃহিণীকে অপহরণ করে
মনুসংহিতা স্পষ্ট বলছে—
আততায়ী গুরু, বালক, বৃদ্ধ বা বিদ্বান হলেও তাকে বধ করতে হবে।
ভারতীয় যুদ্ধনীতি বনাম বিদেশি বর্বরতা
ভারতের যুদ্ধনীতি সবসময় ন্যায়ভিত্তিক। সৈন্য যুদ্ধ করবে সৈন্যের সঙ্গে, সাধারণ মানুষ থাকবে সুরক্ষিত।
• গ্রিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস (চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়ে) লিখেছিলেন—ভারতের সেনারা যুদ্ধ করলেও কৃষকরা নির্ভয়ে জমিতে লাঙল চালায়।
• নবম শতকের আরব বণিক সুলেমান বলেছেন—ভারতের রাজারা প্রতিবেশী রাজ্য দখল করলেও সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার চালাত না।
এভাবেই ভারতীয় যুদ্ধনীতি আধুনিক জেনেভা কনভেনশন-এর বহু আগেই নির্ধারিত হয়েছিল।
কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীতে ইসলামি আক্রমণকারীরা ভারতে বারবার “পূর্ণ যুদ্ধ” চালিয়েছে—লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ছিল তাদের স্বভাব।
অস্ত্রপূজা : কর্মই উপাসনা
হিন্দুধর্ম অস্ত্রের মধ্যেও দেবত্ব খুঁজে পায়।
নবরাত্রির নবম দিনে আজও আমরা আয়ুধ পূজা করি।
• সঙ্গীতজ্ঞ তাদের যন্ত্রে,
• কৃষক লাঙলে,
• ছাত্র বইয়ে,
• সৈনিক অস্ত্রে—
ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ দেখেন।
অর্থাৎ কর্মই উপাসনা, আর সেই কর্মের সহায়ক যন্ত্রই পূজনীয়।
আধুনিক বার্তা
হাজার বছর ধরে দাসত্ব, মেকলে-নীতি, বিদেশি মতাদর্শ এবং ধর্মবিরোধী ষড়যন্ত্র ভারতকে দুর্বল করেছে। ইংরেজরা ১৮৭৮ সালে Indian Arms Act করে ভারতীয়দের নিরস্ত্র করে দেয়, যাতে ১৮৫৭ সালের মতো বিদ্রোহ আর না ঘটে।
আজ প্রয়োজন—
• শাস্ত্রের প্রজ্ঞা
• শস্ত্রের শক্তি
• আর আত্মরক্ষার ন্যায়নীতি
গীতার আদর্শ, চাণক্যের নীতি এবং আমাদের ঐতিহ্য আজও প্রাসঙ্গিক।
উপসংহার
হিন্দু ঐতিহ্য সর্বদাই অহিংসাকে মর্যাদা দিয়েছে, তবে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। গীতার শিক্ষা, অর্থশাস্ত্রের নীতি এবং অস্ত্রপূজার ঐতিহ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
যেখানে শাস্ত্র, সেখানে শস্ত্রও চাই।
শক্তি ছাড়া শান্তি অসম্ভব।
আজ ইসরায়েলের সাফল্য আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে—
শাস্ত্র ও শস্ত্রের সমন্বয়ই টিকে থাকার মূলমন্ত্র।
👉 পাঠকদের প্রতি অনুরোধ :
এই বিষয়ে আপনার মূল্যবান মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুলবেন না। লেখাটি শেয়ার করুন যাতে আরও মানুষ এই বার্তাটি জানতে পারে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন