সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিশ্বকর্মা পুজোতেই রাষ্ট্রীয় শ্রমিক দিবস কেন?


সাধন কুমার পাল ::ভারতে শ্রম দিবস হিসাবে পালিত মে দিবস কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে? নতুন ভারত গড়ে তুলতে শ্রমিকদের অবদানকে সম্মান জানাতে ভারত কি আনুষ্ঠানিকভাবে '১ মে' পরিবর্তে 'বিশ্বকর্মা দিবস'  পালন করবে? এই ধরনের প্রশ্নগুলি এখন প্রতি বছর ১ মে ক্রমবর্ধমানভাবে উত্থাপিত হচ্ছে কারণ ভারতের বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন, ভারতীয় মজদুর সংঘ (বিএমএস), ১ মে শ্রমিক দিবস হিসাবে উদযাপন করছে না। হরিয়ানা সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষনা করেছে পয়লা মে নয় শ্রমিক দিবস পালন হবে বিশ্বকর্মা পূজোর দিন। অনেক রাজ্য সরকার সেই পথেই হাটছে। এর দুটো কারণ হতে পারে ।এক) মে দিবস ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগেই।অর্থাৎ বিশ্ব জুড়ে কমিউনিষ্টদের প্রভাব যতই কমছে ততই বেআব্রু হচ্ছে মে দিবসে ইতিহাসের নামে কমরেডদের সাজানো গল্প।
যখন বিএমএস প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ভারতে শ্রমিক আন্দোলনে বাম- এবং কংগ্রেস-সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়নের আধিপত্য ছিল। বিএমএস ভারতীয় চিন্তন শৈলীর ভিত্তিতে একটি ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে বিশ্বাসী মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে, এটি 'জাতীয়তাবাদ'-এর উপর ভিত্তি করে ভারতের ঐতিয্যগত 'পারস্পরিক সহযোগীতা ও সহমর্মীতার ' চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছিল । সেজন্য শুধু মে দিবস নয় ১৯৫৫ সালে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিএমএস বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারি 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগান কে পাল্টে 'মজদুর ভাই দুনিয়াকো এক করো ' নতুন স্লোগান কে জনপ্রিয় করে তুলেছে। 'ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাওয়ের' জায়গায় নুতন স্লোগান এনেছে, 'দেশের হিতে করবো কাম, নেবো তাতে পুরা দাম'।জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে, বিএমএস "সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং ন্যায়সঙ্গত বন্টন" তত্ত্বে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুঁজিবাদ উৎপাদনের গুরুত্বকে অতিরিক্ত জোর দেয়। সমাজতন্ত্র বণ্টনের দিকটিকে অতিরিক্ত জোর দেয়। কিন্তু বিএমএস উভয়ের উপর সমান গুরুত্বদেয়। সর্বোচ্চ উৎপাদন হল শ্রমের জাতীয় কর্তব্য, কিন্তু একই সঙ্গে উৎপাদনের সুষম বণ্টন ‘শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার’। বিএমএস তাই শ্রমক্ষেত্রে দেশপ্রেমের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন স্লোগান চালু করেছে: “আমরা জাতির স্বার্থে কাজ করব এবং পূর্ণ মজুরি দাবি করব”।          
        ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (BMS) 'বিশ্বকর্মা দিবসকে' জাতীয় শ্রম দিবস হিসাবে উদযাপন করে থাকে। বিশ্বকর্মা বর্তমান দিনের চিন্তা প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনের প্রতীক। ভারতীয় ভাবনায় কাজকে যজ্ঞ হিসেবে মনে করা হয়। ভারতে এক একটি শিল্পে কর্মরত সকলের মধ্যে 'শিল্প সম্পর্ক' ঐতিহ্যগতভাবে পরিবারের মতো সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে । বিএমএস একটি আদর্শ ভারতীয় পরিবারকে 'শিল্প সম্পর্কের মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে' এবং ‘শিল্প পরিবার’-এর মহান ধারণাকে সামনে রেখেছে। এটি 'পশ্চিমের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক' কমিউনিস্টদের শ্রেণী শত্রু ধারণার বিপরীত। 
       

  সমগ্র বিশ্বজগতের শ্রেষ্ঠ স্থপতি হলেন প্রভু বিশ্বকর্মা৷ ঋক বেদে বর্ণিত প্রাচীনতম দেবতাদের মধ্যে অন্যতম তিনি৷ সমাদৃত হয়েছেন স্বর্গের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী, স্থপতি এবং ভাস্কর হিসাবে৷ মর্ত্যে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাপুরী নির্মাণের জন্য ডাক পড়েছিল বিশ্বকর্মার৷ তাঁর পারদর্শিতার ছোঁয়ায় যদুপতি কৃষ্ণের দ্বারকাপুরীর যে রূপ তিনি দিয়েছিলেন, তা আজও বিস্ময় জাগায়৷ দ্বারকা নগরীর বাস্তুবিদ্যা ও নগর পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ অধুনা স্থাপত্যবিদরা৷ বিশ্বকর্মা একজন কাগরিগর। এক কথায় শিল্পের দেবতা তিনি। নিজেদের কর্মোন্নতির জন্য যুগ যুগ ধরে শ্রমিকেরা বিশ্বকর্মার আরাধনা করে আসছেন৷ সুপ্রাচীন কালে ভারতবর্ষে এ দিনই ছিল শ্রমিক দিবস। ধরাধামে একজন কর্মকার রূপেই পুজিত হন তিনি৷ তাঁর চার হাতের মধ্যে এক হাতে রয়েছে দাঁড়িপাল্লা ও অন্য দুই হাতে হাতুড়ি ও ছেনি। রামায়ণেও একাধিক স্থলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডে উল্লিখিত হয়েছে, বিশ্বকর্মা দুটি ধনুক নির্মাণ করেছিলেন। দেবতারা এর মধ্যে একটি ত্রিপুরাসুর বধের জন্য শিবকে এবং অপরটি বিষ্ণুকে প্রদান করেছিলেন। বিষ্ণু তার ধনুকটি দিয়েছিলেন পরশুরামকে। প্রভু রাম ভগবান শিবের ধনুক ভঙ্গ করেই সীতাকে বিবাহ করেন৷ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচী উভয়েই শাপভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁদের মোট নয়টি সন্তান হয়। শিল্পী বিশ্বকর্মা নিজের সন্তানদের মধ্যেও শৈল্পিক সত্ত্বা জাগিয়ে তুলেছিলেন৷ বিভিন্ন শিল্পে পারদর্শী করে তুলেছিলেন তাঁদের৷ তিনি কর্মকারকে লৌহশিল্প, কাংস্যকারকে কাঁসার শিল্প, শঙ্খকারকে শঙ্খশিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎশিল্প, সূত্রধরকে কাঠের শিল্প, স্বর্ণকারকে স্বর্ণশিল্প প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে তাঁদের শিল্পী হিসেবে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিতকরেন। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তাই সমস্ত শিল্প শ্রমিকেরা তাঁদের পূর্বজকে স্মরণ করেন, আরাধনা করেন বিশ্বকর্মার। তিনি আমাদের দেশের মেহনতি মানুষের নিজস্ব দেবতা। সুপ্রাচীন কালে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটিই ছিল শ্রমিক দিবস।##


//আপনার মূল্যবান মন্তব্য এই ব্লগকে সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করবে। সেজন্য লেখাটি পড়া হয়ে গেলে আপনার মন্তব্য নথিভুক্ত করবেন এই আশা রাখছি। //

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ভারতের প্রথম "Gen Z Movement"

          লিখেছেন :: সাধন কুমার পাল Gen Z বা  Generation Z  হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে (কিছু গবেষক ১৯৯৫–২০১০ বা ২০০০–২০১৫ পর্যন্তও ধরে নেন)। অর্থাৎ, এই প্রজন্মের মানুষদের বর্তমান বয়স আনুমানিক ১২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। ২. নামকরণের কারণ: • Baby Boomers  (১৯৪৬–১৯৬৪) • Generation X  (১৯৬৫–১৯৮০) • Millennials  বা  Gen Y  (১৯৮১–১৯৯৬) • তার পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় Gen Z। "Z" অক্ষরটি এসেছে ধারাবাহিকতার কারণে। ৩. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য: • Gen Z হল প্রথম প্রজন্ম যারা জন্ম থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠেছে। • এদের বলা হয় Digital Natives (ডিজিটাল-প্রাকৃতিক)। • Facebook, Instagram, YouTube, TikTok, Snapchat, WhatsApp – এসব প্ল্যাটফর্ম এদের জীবনের অংশ। ৪. শিক্ষাগত ও মানসিক বৈশিষ্ট্য: • তথ্য জানার জন্য বইয়ের বদলে বেশি ব্যবহার করে গুগল ও ইউটিউব। • মনোযোগের সময়কাল তুলনামূলকভাবে ছোট (short attention span), তবে একসাথে অনেক তথ...

তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডর: সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য

                                                                    সাধন কুমার পাল     বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেন'স নেক অঞ্চলটি  নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনূস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয়  রাজ্যগুলিকে(সেভেন সিস্টারস) "স্থলবেষ্টিত" বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে  "সমুদ্র পথে  প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক" হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।  ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমান ঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমুনিরহাট বিমান ঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভ...

শিক্ষকদের কান্নায় কি ডুববে মমতার সিংহাসন?"

                                                   সাধন কুমার পাল     ত্রিপুরায় তখন রক্তমাখা লাল রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ছিলেন সিপিএমের মানিক সরকার, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘সাদামাটা মুখ্যমন্ত্রী’ নামে। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে বাম সরকারের আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘিরে একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন কিছু প্রার্থী। আগরতলা হাই কোর্ট চাঞ্চল্যকর রায় দেয়—পুরো প্যানেল অবৈধ, বাতিল করতে হবে। সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় তৎকালীন সরকার, কিন্তু ২০১৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও হাই কোর্টের সিদ্ধান্তেই সিলমোহর দেয়। এই রায়ের ঢেউ রাজনীতির ময়দানেও পড়ে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে ক্ষমতা হাতছাড়া হয় মানিক সরকারের। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগকে ‘বেআইনি’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে কলকাতা হাই কোর্...